আমার আব্বা ভোলা শহর থেকে বাজার নিয়ে ফেরার পথে পত্রিকা আনতে ভুলতেন না। আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলতেন নে আজকের ‘কাগজটা’ পড়। আমি তেমন কিছুই বুঝতাম না। তবুও পড়তাম। এভাবেই সর্ব প্রথম পত্রিকার নেশার বীজ আমার মাথায় ঢোকে। আব্বা বেশীরভাগই আনতেন ‘দৈনিক আজাদ’ পত্রিকা। মাঝে মধ্যে আজাদ না পেলে ‘দৈনিক ইত্তেফাক’ আনতেন। তখন মূলৎ দেশে এ দুটো বাংলা পত্রিকাই চলতো। পত্রিকা হাতে পেলে আমার আর আমার বড় বোনের একমাত্র কাজ হতো মাস্টহেড থেকে প্রিন্টার্স লাইন পর্যন্ত গোগ্রাসে পড়ে ফেলতাম। অনেক কিছুই বুঝতাম না, তবুও পড়তাম। এভাবেই সেই শৈশবের সূচনাতে পত্রিকার সঙ্গে আমার একটা নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আজ বার্ধক্যে এসেও সেই সম্পর্কে চীড় ধরেনি। হয়তোবা শেষ দিন পর্যন্ত এটা অক্ষুন্ন থাকবে।
১৯৬৫ সালের ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ দেশের সকল মানুষকে নাড়া দিয়েছিল। ভারতীয় বিমান হামলার আশঙ্কায় এক ধরনের আতংকের মধ্যদিয়ে কাটিয়েছে দেশ-গ্রামের প্রতিটি মানুষ। এসময় আব্বা একটি ওয়ান ব্যান্ড রেডিও কিনে এনেছিলেন যুদ্ধের খবর শোনার জন্য। শুনেছি যুদ্ধ উপলক্ষে রেডিও’র দামও বেড়ে গিয়েছিল সে সময়ে। কত টাকা দিয়ে কিনেছে তা আমার স্মরণ নেই। তবে ১৫/১৬ টাকার কম হবে না। সে সময়ে চাউলের মন ছিল ১৫-২০টাকা।
রেডিও কেনার ফলে এলাকায় হুলুস্থল পরে যায়। সে সময় একটি মাত্র ২ ব্যান্ড রেডিও ছিল পরানগঞ্জ বাজারে ইউনুস কাজী সাহেবের দোকানে। অত্যন্ত সহজ সরল দ্বীনদার মানুষ ছিলেন ইউনুস কাজী সাহেব। খবর শুনতে আসা মানুষের অতিরিক্ত ভীরে তিনি রেগে গিয়ে কখনো কখনো রেডিও বন্ধ করে দিতেন। ফলে অনেকেই বব্রত হতেন। তাই বাজারের বিশেষ করে উত্তর দিকের ভীর এসে পরলো আমাদের বাড়িতে। সন্ধ্যা ৮টায় ছিল রেডিও পাকিস্তানের বাংলা ও উর্দু খবর। এসময় মানুষের ভীড় সামাল দেয়ার জন্য উঠানে হোগলা বিছিয়ে দেয়া হতো। মাঝখানে জলচৌকির উপর রেডিওটা ফুল সাউন্ড দিয়ে রাখা হতো। সবাই খবর শুনে চলে যেত। সকাল ৭টার খবরের সময় অবশ্য বাইরের লোকের ভীড় কম হতো।সেই থেকে প্রতিদিন সকাল বেলায় খবর শোনার অভ্যাসটি দীর্ঘ অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে আজো ছাড়তে পারিনি। অবশ্য রেডিওর যায়গা অনেক আগেই টিভি এসে দখল করে নিয়েছে। এ অভ্যাসটিও হয়তোবা আমরণ থাকবে।
১৯৬৪ সালে যখন বিটিভি’র উদ্বোধন হয়, আমি তখন ৬/৭ বছরের শিশু। পাকিস্তান টেলিভিশন নামে মতিঝিল ডিআইটি ভবনে এর সম্প্রচার শুরু হয়। দৈনিক ইত্তেফাক এ খবরটি ফলাও করে প্রকাশ করেছিল। আব্বা পত্রিকাটি এনে আমাদেরকে বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন ‘টেলিভিশন’ কাকে বলে। রেডিওতে শুধু গান শোনা যায়, টিভিতে দেখাও যাবে শোনাও যাবে। আব্বার কথা শুনে শুধু আমরা নই বড়রাও অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে ছিলেন। সেই ছোট বেলায়ই বাসনা ছিল একবার যদি জিনিষটা দেখতে পারতাম। তখন ইত্তেফাকে রোববার ছুটির দিন সিনেমা পাতা বের হতো ‘রুপবানী’ নামে। বিটিভি’র উদ্বোধনের পরের রোববারে ‘রুপবানী’ ছিল বিশেষত টেলিভিষন উদ্বোধন নিয়ে। উদ্বোধনী সংগীতটি গেয়েছিলে বাংলার গানের পাখি আব্বাস উদ্দিন তনয়া সনামধন্য সংগীত শিল্পি ‘ফেরদৌসী রহমান’। টেলিভিষনে ফেরদৌসী রহমানের গান গাওয়ার ছবিটি ‘রুপবানী’তে বেশ বড় করে ছাপা হয়েছিল। এ ছবিটি আমার বড় বোন রাহিমা আক্তার নিরু পড়ার টেবিলের পাশে বেড়ায় আটা দিয়ে লাগিয়ে রেখেছিল। বহু বছর ছবিটি জীর্ণশীর্ণ অবস্থায় আমাদের চোখের সামনে ছিল।
এসব নানা কারনে পত্র-পত্রিকা রেডিও-টিভি তথা গণমাধ্যমের প্রতি এক ধরনের ঝোক আমার শৈশবেই তৈরী হয়েছিল। স্কুলে পড়াশোনার সময়ও অন্যান্য বিষয়ের চেয়ে বাংলা ও ইতিহাসের প্রতি আমার অতিরিক্ত আগ্রহ ছিল। প্রাইমারী থেকে বিএ পরীক্ষা পর্যন্ত আমি ক্লাশের মধ্যে সর্বোচ্চ নম্বর পেতাম বাংলা ও ইতিহাসে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েও প্রথম ভর্তি হয়েছিলাম বাংলায়। পরে মোশারেফ হোসেন শাজাহান ভাই এর পরামর্শে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার স্বপ্নে ১ম বিভাগ অর্জনের খেয়ালে ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগেচলে আসি। যদিও একজন শিক্ষকের রোসানলে পরে সে স্বপ্ন আমার স্বপ্নই রয়ে যায়। আসলে ভাগ্যের তরী কার কোথায় গিয়ে ভীড়বে সে নিজেও টের পায় না। তাইতো উর্দুতে একটি প্রবাদ আছে ‘ইনসান জো চাহাতে হায় উ নেহি হোতা হায়, জু ভি মনজুরে খোদা হায় উভি হোতা হায়।’ আসলেই সৃস্টিকর্তা মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যা ঠিক করেছেন সেটাই ঘটে। একেই বলে ‘বিধি লিপি’।
আমার স্কুল জীবনে সাহিত্যচর্চা, সাংবাদিকতা কিংবা নান্দনিকতার বিকাশের তেমন কোন সুযোগ ছিল না। তবে এ সময়ই ছোট ছোট ‘ছড়া’ লেখা শুরু করি। যার মধ্য থেকে কিছু পরবর্তীতে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। এ ব্যাপারে আমার গুরু ছিলেন আমার বড় বোন রাহিমা আক্তার নিরু। আপা কথায় কথায় ছড়া কাটতেন, আবার ছন্দ মিলিয়ে কবিতা লিখতেন। যদিও তাঁর লেখা কবিতাগুলো আমরন খাতাবন্দী থেকে এক সময় মুছে গেছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস আপা যদি তার প্রতিভা বিকাশের সুযোগ পেতেন তাহলে নিঃসন্দেহে তিনি বাংলাদেশের একজন প্রথিতযশা কবি সাহিত্যিক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করতে পারতেন। এখানেও সেই ‘বিধি লিপি’। হয়তো সৃষ্টিকর্তা চাননি তাই হননি। তবে আমার অনুপ্রেরনার উৎস ছিলেন তিনি।
বাংলাদেশ সময়: ১১:০৮:৪০ ৩০৬ বার পঠিত |