লালমোহনে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুশ্রম বাড়ছে

প্রথম পাতা » প্রধান সংবাদ » লালমোহনে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুশ্রম বাড়ছে
মঙ্গলবার, ২৫ আগস্ট ২০২০



সাব্বির আলম বাবু।।ভোলাবাণী।।বিশেষ প্রতিনিধি।।

ভোলার লালমোহনে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুশ্রম বাড়ছে। এ সকল শিশুরা বেশীর ভাগই শিক্ষা বঞ্চিত,মায়া-মমতাহীন ভাবে বেড়ে উঠেছে। বস্তবতার কঠিন কষাঘাতে দুইবেলা দু’মুঠো ভাতের জন্য তাদের নিরন্তর সংগ্রাম করতে হচ্ছে কচি কোমল হাতে। শিশুদের শ্রম মজুরি কম হওয়ায় মহাজন বা মালিকরা তাদের দিয়ে অমানুষিক পরিশ্রম করিয়ে কম খরচে বেশী লাভের ধান্দা করছে। দারিদ্র, অশিক্ষা, পারিবারিক বিচ্ছেদ, পরিবারের সদস্য বৃদ্ধি, বাবা বা মায়ের একাধিক বিবাহ, পরিবারের উর্পাজনক্ষম ব্যক্তির মৃত্যু, নদী ভাঙ্গনের ফলে ভিটেমাটি শূন্য হয়ে নানারকম প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে সৃষ্ট দুরাবস্থায় পতিত শিশুরাই মুলত ধীরে ধীরে হয়ে উঠছে শিশু শ্রমিক। তবে আশংকার বিষয় হচ্ছে এ সকল শিশু শ্রমিকের বড় একটি অংশ নানা রকম অপরাধ মুলক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ছে। স্বাস্থ্য, পুষ্টি, বাসস্থান, চিকিৎসা, বিনোদন, শিক্ষা ও নিরাপত্তা লাভের মৌলিক অধিকার বঞ্চিত এসব শিশুরা মানসিক ভাবে অসুস্থ্য হয়ে পরছে। রাত জেগে কাজ করা, অবহেলা, পর্যাপ্ত আলো বাতাসের অভাব, আগুনের ঝুঁিকপূর্ণ ব্যবহার, ময়লা- নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ শিশু শ্রমিকদের ভবিষ্যত পঙ্গু করে দিচ্ছে।

ছবির ক্যাপশন ঃ লালমোহনে টেম্পু মেরামতে ব্যস্ত দুই শিশু শ্রমিক।

এ সকল শিশু শ্রমিকদের সাধারনত রিক্সা-ভ্যান চালানো, নদীতে মাছ ধরা, গ্যাস ঝালাই-ওর্য়াকসপ, ইটভাটা, অটোমোবাইল কারখানা, জুয়েলারি, চায়ের দোকান, কাঠ ও রাজমিস্ত্রী ও মাদকদ্রব্য বহনের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। যে বয়সে হাতে বই খাতা নিয়ে স্কুলে যাওয়ার কথা সে বয়সেই এসব শিশুদের কচিকোমল হাতে নিতে হচ্ছে লোহার শক্ত হাতুরি। উত্তাল নদীতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাছ ধরতে হচ্ছে তাদের। অপরদিকে মেয়ে শিশুদেরও শ্রম বিক্রি করতে হচ্ছে সমাজের অভিজাত শ্রেণীর লোকদের বাসাবাড়ীতে। পান থেকে চুন খসলে তাদের কপালে ঘনিয়ে আসে নির্মম নির্যাতন। কখনো মারপিট, গরম লোহার খুন্তি দিয়ে ছ্যাঁকা দেয়া আবার কখনো গৃহকর্তার লালসার শিকার ইত্যাদি প্রায় লেগেই আছে। ইউনিসেফের জড়িপে দেখা যায়, বাংলাদেশে ৫০% গৃহ পরিচারিকা যৌন হয়রানির শিকার হয়। ২০০৫-২০১১ সালের জুন পর্যন্ত ১৭৩৪ জন কন্যা শিশু ধর্ষনের শিকার এবং ১৯ জন গণধর্ষনের শিকার। ২০১১ সালে এসিড নিক্ষেপের শিকার হয়েছে ১৬ জন কন্যা শিশু। ইভটিজিংয়ের শিকার হয়ে লেখাপড়া বন্ধ হয়েছে অনেক অনেকের। মানবতা এখানে ভূ-লুন্ঠিত হচ্ছে ভীষণভাবে।
বিভিন্ন কারণে পরিবার থেকে বি”িছন্ন হওয়া ছেলে-মেয়েরা শহরে চলে যায়। শহরে গিয়ে তারা প্রথমে কোনো কাজ বা আশ্রয় পায় না। শহরের অলিগলি, ফুটপাতে তাদের রাত কাটে। এক পর্যায়ে এসব শিশুরা অপরাধের সঙ্গে জড়িত টোকাইদের সঙ্গে পরিচয়ের সুবাদে নানা ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। কেউবা বাসা-বাড়ি, হোটেল-রেস্তোরাঁয় বা কারাখানায় ঝুঁকিপূর্ণ কাজ নেয়। শুধু তিন বেলা খাবারের জন্য এসব শিশুরা মাদক বিক্রি ও বহন, অবৈধ পিস্তল বহন, চুরি, ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপরাধের জড়িয়ে পড়ে। একশ্রেণীর সন্ত্রাসীরা শিশুদের দিয়ে এসব অপরাধ করায়। বিনিময়ে কিছু টাকা দেয়া হয়। কোনো কোনো সময় এসব শিশুদের বিভিন্ন রাজনৈতিক সহিংসতায়ও ব্যবহার করা হয়। সঠিক নীতিমালা না থাকায় নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হ”েছ এসব শিশুরা। নির্যাতনের শিকার এসব শিশুরা সঠিক আশ্রয় এবং পড়ালেখার সুযোগ না পাওয়ায় অপরাধী হয়ে উঠছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, পারিবারিক ও আর্থসামাজিক কারণে সাধারণত ৭ থেকে ৮ বছরের শিশুরা জীবন ধারনের জন্য শ্রম বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। লালমোহন উপজেলার ওয়েল্ডিং কারখানার শিশু শ্রমিক র“বেল জানায়, ‘আমার বাজান ভ্যান চালায় কিন্তু ঘরে ভাইবোন বেশি হওয়ায় বাজান আমারে এইহানে দিয়া গ্যাছে।’ চায়ের দোকানের কারিগর মহসিন জানায়, ‘আমি ভোর থেকে অনেক রাত পর্যন্ত দোকানে কাজ করে দৈনিক ৫০ টাকা পাই, তারপরও ছুটি পাই না।’
বিভিন্ন পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বাংলাদেশে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৯০ লাখ। আর মেয়ে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৪০ লাখ । মেয়ে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা সবচেয়ে বেশী পোশাক শিল্প কারখানায়। কোন কোন সেকশনের মোট শ্রমিকের প্রায় ৫০ শতাংই মেয়ে শিশু শ্রমিক। মাদকদ্রব্য চোরাচালানের নির্ভরযোগ্য বাহক হচ্ছে শিশুরা। দেশের শতকরা ১০জন শিশুর মাঝে একজন শ্রমিক। বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালের শিশু আইনে ১৬ বছর বয়স পর্যন্ত এবং ন্যশনাল চিলড্রেন পলিসি ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত যে কাউকেই শিশু হিসাবে গন্য করা হয়েছে। কিন্তু শিশুশ্রম নিরসনের জন্য ১৯৭৩ সালের জুন মাসে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) ৫৮তম অধিবেশনে নুন্যতম বয়স সংক্রান্ত কনভেনশন ১৩৮ গৃহীত হয়। এ কনভেনশনে ঘোষণা করা হয় ১৮ বছরের কম বয়সী সকল শিশুই শ্রমের আওতা মুক্ত। তাই এ বয়সী কোন শিশুকেই ঝুঁকিপূর্ণ কাজে লাগানো যাবে না।

বাংলাদেশে শ্রমিক কন্যা শিশু ৭৩.৫%,ছেলে শিশু ২৬.৫%। ১০-১৪ বছর বয়সী ২৩ লাখ। ১৫-১৬ বছর বয়সী ২৪ লাখ। ৫-১৭ বছর বয়সী ৮০ লাখ। কন্যা শিশু সরাসরি অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের সাথে জড়িত। ৫-১৪ বছর বয়সী ৪ লাখ গৃহ শ্রমিকের মধ্যে ৭৫%ই কন্যা শিশু। ১৮ বছরের নীচে প্রায় ২০ হাজারের বেশী কন্যা শিশু বানিজ্যিক ভিত্তিতে যৌন পেশার সাথে জড়িত। তথ্যে আরো জানা যায়, বাংলাদেশের শিশু শ্রমিকরা ৩৪৭ ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের সাথে জড়িত। তার মধ্যে ৪৭ ধরনের কাজই ঝুঁকিপূর্ণ। লালমোহনের এ সকল শিশুরা জীবন ধারনের জন্য বহু কষ্টে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে লিপ্ত হচ্ছে। সাথে সাথে অপরাধ চক্রের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে, পাশাপাশি শারিরিক নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে ।

প্রশাসনের উদাসীনতা এবং সরকারের মনিটরিংয়ের অভাবের ফলে দ্র“ত শিশু শ্রমিকের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই সংকট নিরসনের জন্য সরকারকে শিশুশ্রম নীতিমালা বস্তবায়ন করতে আহ্বান করছে সচেতন মহল।

বাংলাদেশ সময়: ২২:০৯:১৭   ২৫০ বার পঠিত  |




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

প্রধান সংবাদ’র আরও খবর


বাংলার প্রথম ‘ম্যাট্রিক পাস’ কারা ছিলেন?
রেজিলিয়েন্ট হোমস্টেট এন্ড লাইভলিহুড সাপোর্ট টুদ্যা ভারনালেবল কোস্টাল পিপল অব বাংলাদেশ শীর্ষক আলোচনায়ভোলায় দুর্যোগের সম্মুখিন হওয়া মানুষদের বাদ দিয়ে সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব নয়: জেলা প্রশাসক
জনগণের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছে দিতে আমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ: মোহাম্মদ ইউনুস
উপজেলা পরিষদ নির্বাচন ২০২৪ মনপুরায় শেষ দিনে ৯ প্রার্থীর মনোনয়ন পত্র দাখিল ॥
মনপুরায় কালবৈশাখী ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মাঝে নগদ অর্থ বিতরন ॥
মনপুরায় কোস্ট ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে অবহিতকরন সভা অনুষ্ঠিত
উপজেলা পরিষদ নির্বাচন ২৪মনপুরায় চেয়ারম্যান পদে মনোনয়ন পত্র দাখিল
দক্ষিণ আইচায় ধান ক্ষেতে অজ্ঞাত যুবকের লাশ উদ্ধার
চরফ্যাশনে পলিথিন ও প্লাস্টিক পুড়িয়ে তৈরি হচ্ছে জ্বালানি তেল
ভোলায় লাশ গোসলের আধুনিক স্থাপনা গড়ে তোলা হবে: জেলা প্রশাসক

আর্কাইভ