আজ সেই ভয়াল ১২ই নভেম্বর। ৫৩ বছর আগের সেই দিনের বেদনা বিধুর ইতিহাস উপকুলবাসী আজও ভুলতে পারেনি। এ দিনটি উপকুলবাসীর জন্য শোকের দিন। স্বজনহারা পরিবারের আর্তনাদ। ১৯৭০ সালের এই দিনে সমগ্র উপকূল জুড়ে বয়ে যায় মহা প্রলয়ংকরী ঘূর্নীঝড় ও জলোচ্ছাস। ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত বুঝতে না পারার খেসারত দিতে হয়েছে উপকুলবাসীর প্রান বিসর্জনের মধ্য দিয়ে। প্রবল জোয়ারের স্রোতে ভেসে যায় গবাদি পশু,হাঁস-মুরগী আর ক্ষতিগ্রস্ত হয় পশু-পাখি,ফসল এবং অসংখ্য গাছপাল। পুরো উপকূল মুহুর্তেই ধ্বংসজজ্ঞে পরিণত হয়। চারদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে লাশ আর লাশ। বাতাসে লাসের গন্ধ আর স্বজনদের আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে উপকুলের আকাশ বাতাস। ভোলা,পটুয়াখালী,বরগুনা,নোয়াখালী ও চট্রগ্রামের উপর দিয়ে বয়ে যায় এই ঘূর্নীঝড় ও জলোচ্ছা।
প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয়দের সাথে আলাপ করে জানা যায়,১৯৭০ সালের ১২ই নভেম্বর সে দিন ছিল বৃহস্পতিবার। সকাল থেকেই গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। বিকেলের দিকে বাতাস বাড়তে থাকে। রাতের দিকে আবহাওয়া অধিদপ্তর প্রচার করতে থাকে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত। বঙ্গোপসাগরের সৃষ্ট নিম্মচাপটি হারিকেনের রুপ ধারন করেছে এবং যার প্রভাবে উপকূলীয় এলাকায় ২০/২৫ ফুট উ”চতায় জলোচ্ছাসের সম্ভাবনা রয়েছে। দুর্ভাগ্য উপকূলের মানুষের কানে এ সতর্কবানী পৌঁছেনি। তখন ছিল পবিত্র রমজান মাস। বৃহস্পতিবার রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে । গভীর রাতে হঠাৎ মানুষের আত্মচিৎকারে সবাই জেগে ওঠে। বাইরে প্রচন্ড বেগে বাতাস বইছে। চোখের পলক ফেলতে না ফেলতেই তীব্র গতিতে জোয়ারের পানি ঘর ডুবে আসবাবপত্র ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সবাই ছোটাছোটি করে বেঁচে থাকার লড়াইয়ে লিপ্ত হয়। ঘর-বাড়ি,গাছ-পালা ভাঙ্গার বিকট শব্দে প্রকৃতির ভয়ংকর গর্জনে মনে হয়েছে যেন কেয়ামত বুঝি শুরু হয়ে গেল। মানুষের বেঁচে থাকার করুন আকূতি। কেউ চনের(নাড়া) চালায়,টিনের চালায় ,কেউ গাছের মগডালে,কেউ হাতের কাছে যা পেয়েছে তাই ধরে বেঁচে থাকার শেষ চেষ্টা করেছে। এতেও শেষ রক্ষা হয়নি অনেকের। জলোচ্ছাসের তোড়ে ভেসে গিয়ে মুহুর্তের মধ্যে প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছে লক্ষ লক্ষ মানুষকে। শেষ রাতের দিকে মুহুর্তেই প্রকৃতি শান্ত হয়ে যায়। আস্তে আস্তে পানি নেমে যায়। চতুর্দিকে ভেসে আসে মানুষের আর্তনাদ। সন্তান হারা মায়ের কান্না,মা হারা সন্তানের চিৎকার,ভাই হারা বোনের বুকফাটা ধ্বনিতে আকাশ বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। সর্বহারা মানুষগুলো একে অপরের মুখের দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে লজ্জ্বা ঢাকার জন্য এক টুকরো ছেঁড়া কাপড় খুজতে থাকে।
১২ই নভেম্বরের মহাপ্রলয়ংকরী ঘূর্নীঝড় ও জলোচ্ছাসে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ভোলা জেলার বিচ্ছিন্ন দ্বীপ উপজেলা মনপুরায়। মনপুরার কোথাও বেড়ী বাঁধ কিংবা সাইক্লোন শেল্টার তখনও গড়ে ওঠেনি। গাছ পালা তেমন একটা লম্বা বা মোটা ছিলনা। সাগর মোহনার ২০-২৫ ফুট উচু ঢেউ ও জলোচ্ছাসে মনপুরার ৩০ সহস্রাধিক মানুষ ও গবাধি পশু স্রোতের টানে ভেসে গেছে উত্তাল সাগরে। প্রকৃতি শান্ত হলে দেখা যায়,গাছে গাছে ঝুলে আছে লাশ আর লাশ। যেখানে সেখানে লাশ আর লাশ। সাপ আর মানুষের একসাথে জীবন বাঁচানোর শেষ চেষ্টার নিদর্শন দেখে মানুষ যেমন হয়েছে আতংকিত তেমনি হয়েছে অভিভুত। মনপুরায় বেঁচে ছিল মাত্র ৮ হাজার স্বজন হারানো ব্যাথাতুর মানুষ।
ভোলা জেলার লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যূর খবর আর ঘূর্নিঝড়ের তান্ডবে লন্ডভন্ড উপকূলীয় জনপদের বেদনার্ত কাহিনী ৩/৪ দিন পর রাজধানী জানতে পারে তৎকালীন দৈনিক পুর্বদেশ পত্রিকার মাধ্যমে। বর্তমানে ভোলা থেকে প্রকাশিত দৈনিক বাংলার কন্ঠের সম্পাদক মোঃ হাবিবুর রহমান ছিলেন সেই সময়ের পূর্বদেশ পত্রিকার ভোলা জেলা প্রতিনিধি। “ ভোলায় ঝুলছে গাছে গাছে লাশ” শিরোনামে পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশের পর প্রশাসনের পাশাপাশি বিভিন্ন সংস্থা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। পর্যায়ক্রমে আসতে থাকে ত্রান সামগ্রী। হেলিকপ্টার থেকে বিভিন্ন ত্রানসামগ্রী ফেলে যাওয়া আজও দক্ষিনাঞ্চলবাসীর মনকে নাড়া দেয়। সেই দিনের আলোচনা উঠলে এখনো অনেকেই নীরবে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। উপকুলবাসীর খোঁজ খবর নিতে ৫দিন পর ছুটে আসেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি ত্রান নিয়ে আসেন। অসহায় মানুষের মাঝে ত্রান বিতরন করেন।
দিনটির স্মৃতিচারন করতে গিয়ে মনপুরা উপজেলা সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আঃ লতিফ ভূঁইয়া বলেন,এদিনটি এলেই আমার মায়ের কথা মনে পড়ে যায়। জোয়ারের প্রচন্ড স্রোত এবং ঝড়ের প্রচন্ড তান্ডব থেকে আমাকে বাঁচাতে মা আপ্রাণ চেষ্টা করে আমাকে নিরাপদ স্থানে রেখে মা সেই যে জোয়ারের পানিতে ভেসে গেলেন আর পাইনি মাকে। সেই বন্যায় আমি আমার পরিবারের মা বাবা,বোনসহ ১৮ জনকে হারিয়েছি। সবাই তখন স্বজন হারা। মৃতের সংখ্যা এতই বেশি ছিল যে ১০/১২ জনকে একসাথে মাটি দিতে হয়েছে।
হাজীর হাট ইউনিয়নের সংরক্ষিত সাবেক ইউ.পি সদস্যা মফিজা খাতুন বলেন,প্রচন্ড ঝড়বৃষ্টি ও ঢেউয়ের মাঝে আমার কোল থেকে ৫ মাসের কন্যা সন্তানটি পড়ে গেলে তাকে ধরার চেষ্টা করি। আমাকে প্রচন্ড স্রোতে বাড়ি থেকে ভাসিয়ে নিয়ে গেলে বেঁচে থাকার জন্য মরা গরুর লেজ ধরি। এই লেজ ধরা অব¯’ায় বঙ্গোপসাগরে ৭ দিন ভাসতে থাকি। এরপর কক্সবাজার থেকে ৩ শত মাইল দক্ষিনে বঙ্গোপসাগর থেকে বহিরাগত একটি জাহাজ আমাকে তুলে চট্রগ্রামের একটি হাসপাতালে ভর্তি করে। ১ মাস পর মনপুরায় ফিরে আসি।
হাজির হাট বাজারের বিশিষ্ট পান ব্যাবসায়ী মরহুম ইয়াছিন বেপারী স্ত্রী বিবি নুরভানু দিনটির স্মৃতি চারন করতে গিয়ে বাকরুদ্ধ কন্ঠে বলেন,সেইদিন ছিল বৃহস্পতিবার। আমার স্মামী প্রতিদিনের ন্যায় নাইবের হাট বাজারে পান বিক্রি করতে যায়। সারাদিন গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি ছিল। বিকাল বেলা আকাশ মেঘে ঢেকে ফেলে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে আকাশের অবস্থা খারাপ দেখে পান বিক্রি বন্ধ করে বাড়ী চলে আসেন আমার স্বমী। তখন রাত আনুমানিক ৯ টা হবে। খাবার খেয়ে আমরা ২ ছেলে ১ মেয়ে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। গভীর রাত হঠাৎ দেখি ঘরের ভিতর পানি। জোয়ারের প্রচন্ড গতি ও বাতাসের তীব্রতায় মুহুর্তের মধ্যে এক বুক পানি হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি করে আমরা উঠে ২ ছেলে ও ১ মেয়েকে নিয়ে ঘর থেকে বাহির হয়ে একটি গাছে উঠি। আমার স্বামী ছেলে হেলাল ও বেলালকে ধরে এবং আমি মেয়ে মহিমাকে ধরি। কিন্তু একদিকে বাতাস অন্যদিকে জোয়ারের তোড়ে শিশু সন্তানদেরকে ধরে রাখতে পারিনি। সেদিনের দুঃসহ স্মৃতির কথা আজও মনে পড়ে। সেই কথা মনে পড়লে আজও কান্না ধরে রাখতে পারিনা বলে চোখের এক কোনা থেকে অশ্রু ঝরতে থাকে তার।
১২ ইনভেম্বরে স্বজনদের মৃত্যুকে স্মরন করে আজও বিভিন্ন সংগঠন মসজিদ ও মন্দিরে দোয়া,মিলাদ ও বিশেষ প্রার্থনা করেন। আজ ভয়াল ১২ই নভেম্বর দক্ষিনাঞ্চলবাসীর জন্য শোকের দিন। উপকুলবাসী উপকুল দিবস হিসেবে এই দিনটি পালন করার জন্য দাবী জানিয়ে আসছেন দীর্ঘদিন।
বাংলাদেশ সময়: ১৮:৫১:৫৩ ৯৭ বার পঠিত |