সাব্বির আলম বাবু।।ভোলাবণী।।লালমোহন প্রতিনিধিঃ
ভোলার লালমোহন সহ দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় সবুজ বেষ্টনীর অপর্যাপ্ততা ও জনসচেতনতার অভাবের কারনে বনভূমি ধ্বংসের পথে। পল্লী প্রকৃতির এক অপূর্ব লীলাভূমি আমাদের এই বাংলাদেশ। প্রকৃতি যেন নিজ হাতে সাজিয়েছেন তার এই আদুরে কন্যাকে, কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য আমরা সেই প্রকৃতির সৌন্দর্য বনভূমিকে রক্ষা করতে পারছি না।
লালমোহনের বিচ্ছিন্ন চর কচুয়ায় মনোরম ম্যনগ্রোভ বন দাড়িয়ে আছে বাড়তি এক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের শোভাবর্ধন করে পর্যটন কেন্দ্র সৃষ্টির আশায়। হোগলা পাতার মধ্যে দিয়ে বয়ে যাওয়া চিকন রাস্তা ধরে হাটতে হাটতে একটু ভিতরে প্রবেশ করলে মনে হবে এ যেন আরেক ভূবন। বনের ভেতরেই প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট বিশাল এক খন্ড শীতল ছায়া বিশিষ্ট মাঠে ইচ্ছে করলে একটু জিরিয়ে নেয়া যায়। চারপাশে মাথা উচু করে দাড়িয়ে আছে বিভিন্ন রকমের বন। ভোজনবিলাসী ও প্রকৃতি প্রেমীরা ইচ্ছা করলে এ চরে এসে দুটো কাজই সারতে পারেন এক সঙ্গে। বনের মধ্যে হারিয়ে যেতে যেতে পশ্চিম দিকে গেলে খুজে পাওয়া যায় মানুষের অস্তিত্ব। প্রথমে দেখা মিলবে বন বিভাগের ছোট্ট একটি অস্থায়ী ফরেষ্ট অফিস। এখানে ক্যাম্প ইনচার্জসহ ৪জন গার্ড দ্বায়িত্ব পালন করে। প্রায় একশ একর জমি জুড়ে বনাঞ্চলে রয়েছে গড়ান, কেওড়া, বাইন,রেইন ট্রি প্রভৃতি মূল্যবান গাছ। এখানে ঘুঘু সহ বিভিন্ন দেশীয় প্রজাতির পাখির অভয়স্থল । শীতের মৌসুমে সুদুর থেকে আসা অতিথি পাখিরাও এখানে আসতে ভুল করে না। এখানে পরিকল্পিত ভাবে বনাঞ্চল শুরু হয় ১৯৮২ সাল থেকে। কোন হিংস্র পশুর ভয় না থাকলেও বনে রয়েছে সাপ। তবে সেগুলো নিশাচর।
বনাঞ্চলের পরিমান সন্তোষজনক হলেও এগলোর রক্ষনাবেক্ষনের জন্য বন বিভাগের পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত কোন ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। ফলে জলদস্যু ও গাছ খেকোদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল এখানে তৈরী হচ্ছে। তাছাড়া কর্তব্যরত ফরেষ্ট অফিসের ষ্টাফদের আত্মরক্ষার জন্য নেই কোন হাতিয়ার। প্রত্যন্ত বনাঞ্চলে তারা জীবন বাজি রেখে কর্তব্য পালন করে। স্টাফদের সাথে আলাপকালে জানা যায়,কর্তৃপক্ষকে বার বার আবেদন করার সত্বেও প্রয়োজনীয় জনবল বৃদ্ধি ও স্থায়ী কোয়ার্টার এখানে স্থাপন করা হয়নি। চরকচুয়ার এ বনাঞ্চল লালমোহন উপজেলার মধ্যে পড়লেও তা চরফ্যাশন ফরেষ্ট রেঞ্জের আওতায়। এই বনে মধু ও হোগলা সহ অন্যান্য খাত থেকে সরকার বছরে ফ্রায় ৩০হাজার টাকা রাজস্ব পায়।
বাংলাদেশের মাটি, জলবায়ু ও বৃষ্টিপাত উদ্ভিদের বিস্তারের জন্য খুবই উপযোগী। কিন্তু তা স্বত্বেও এ দেশের অধিকাংশ এলাকা থাকে অনাবাদি ও পতিত। এর মূলে রয়েছে বন সম্পদের সংরক্ষন ও ব্যবহারের আমাদের অসচেতনতা ও অপরিনামদর্শীতা। আমাদের দেশের মোট ভূমির পরিমান ১ লক্ষ ৪৭হাজার ৫৭০ বর্গ কিলোমিটার প্রায় এবং বনভূমির পরিমান ২.৫৩ মিলিয়ন হেক্টর যা দেশের আয়তনের শতকরা ১৭.৪৯ ভাগ, যা স্বাভাবিক প্রয়োজনের তুলনায় খুবই নগন্য। অপর দিকে অবাদে গাছ কাটা হচ্ছে। পক্ষান্তরে বনভূমি হচ্ছে ধ্বংস। বাংলাদেশের শতকরা ৮০ ভাগ লোকই কৃষিজীবি ও নিরক্ষর। তারা বনভূমি ধ্বংসের পরিনাম সম্পর্কে জানে না। তাছাড়া তাদেরকে এ ব্যাপারে বুঝিয়ে বলার মতো পর্যাপ্ত কোন পদক্ষেপই কোন সচেতন মহলকে নিতে দেখা যায়নি।
অন্যদিকে আমরা বনভমি অর্থাৎ গাছ থেকে পাচ্ছি বেঁচে থাকার জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় যে জিনিস তা হচ্ছে অক্সিজেন। যা মানব তথা প্রাণীকূলের জীবন রক্ষার জন্য অত্যন্ত জর“রী। এছাড়া বন্য,জলোচ্ছাস,সাইক্লোন প্রভৃতি প্রাকৃতিক দূর্যোগে আমাদের একমাত্র প্রকৃত বন্ধু গাছ। বেকার যুবক, বিধবা ও সমাজের উপেক্ষিত নারীদের কর্মসংস্থানের অন্যতম উৎস হচ্ছে এই বনভূমি। বাশঁ,বেত ও মূর্তা চাষের মাধ্যমে অর্থনৈতিক ভাবে তারা স্বাবলম্বী হতে পারে। দেশে বিদেশে বাঁশ,বেত ও মুর্তার তৈরী জিনিসের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।
বনভূমি ধ্বংসের আরেকটি কারণ হচ্ছে অব্যাহত নদী ভাঙ্গন। এই নদী ভাঙ্গনের কারনে বহু লোক তাদের ভিটা,বাড়ী ও জমি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পরে। ফলে তারা বেঁচে থাকার তাগিদে এবং আশ্রয় লাভের আশায় বনভূমির উপর চড়াও হয়। এ ব্যাপারে উপজেলার কালমা ইউনিয়নের মুসা মিয়া জানান, তার এক সময় দৌলতখান উপজেলায় অনেক জায়গাজমি ছিল,ঘরবাড়ী ছিল কিন্তু মেঘনার কড়াল গ্রাসে সে আজ সহায়সম্বল হাড়িয়ে নিঃস্ব। বউ ছেলে মেয়ে নিয়ে বহু কষ্টে দিনাতিপাত করছেন। এরকম কালু,বাসেদ, কালাম,আলীসহ অনেক নিরিহ নিরাপরাধ লোক এই নির্মম ভাগ্য বিরম্বনার শিকার। তবে বনভূমির সম্পদ কাজে লাগিয়ে স্বাবলম্বী হওয়ার ঘটনাও আছে অনেক। তারই একজন কামাল,তিনি জানান, তার বাড়ী চরলক্ষী গ্রামে, তিনি প্রায় বিশ বছর যাবৎ বাঁশ ও বেতের তৈরী জিসিপত্র বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। অনেক লোক অগ্রিম অর্ডার দিয়েও জিনিসপত্র তৈরী করে নেয়।
বনবিভাগ বাহারী বনভূমি তৈরী করেও দক্ষিণাঞ্চলে পর্যটন শিল্প গড়ে তুলতে পারে যার ফলেআয় হবে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা। সকল বাড়ীর আশেপাশে প্রচুর পরিমানে ঔষধী,ফলদ ও কাঠ গাছ লাগানো প্রয়োজন। গ্রামের অধিকাংশ জনসাধারন এখনো ভেষজ উদ্ভিদ ও আর্য়ুবেদিক চিকিৎসার উপর নির্ভরশীল কিন্তু নানারকম ভেষজ ঔষধ তৈরীতে এখনো উপাদান হিসাবে যেসব উদ্ভিদ ব্যবহার করা হয় তার ৭০ভাগই আসে বিদেশ থেকে। এতে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা খরচ হয়। ব্যাপক আকারে চাষাবাদের মাধ্যমে আমাদের দেশেই প্রচুর পরিমানে অর্জুন, বহেরা, হরিতকি, আমলকি, বেল, আকন্দ, নিম, তুলসী,ঘৃতকুমারী,থানকুনি,লজ্জাবতী,সর্পগন্ধা,বাসক,কালমেঘ প্রভৃতি মূল্যবান ঔষধি গাছ জন্মানো সম্ভব।
এর ফলে আমরা রোগ নিরাময়ের পাশাপাশি আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারি। পরিশেষে সরকারের সার্বিক সহযোগীতা ও বনবিভাগের আন্তরিকতার মাধ্যমে বনভূমি সংরক্ষন তথা ধবংসরোধ ও দারিদ্রবিমোচন এবং গ্রামাঞ্চলের জনসাধারনকে এ বিষয়ে সচেতন করতে হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৬:০৮:১৬ ২১১ বার পঠিত |