ভোলা সদর হাসপাতাল-১ ॥ বর্হিবিভাগ দালালদের দৌরাত্ম

প্রথম পাতা » প্রধান সংবাদ » ভোলা সদর হাসপাতাল-১ ॥ বর্হিবিভাগ দালালদের দৌরাত্ম
রবিবার, ৫ নভেম্বর ২০১৭



---শিমুল চৌধুরী ॥ভোলাবাণী।।
শনিবার সকাল পৌনে ৯টা। ভোলা সদর হাসপাতালের বর্হিবিভাগে তখনো কেউ আসেনি। নারী ও পুরুষ টিকিট কাউন্টার দুটি তালাবদ্ধই ছিল। এ সময় বেশ কয়েকজন রোগী বর্হিবিভাগের সামনে ঘোরাঘুরি করতে দেখা গেছে। ২০ মাস বয়সী জমজ দুই শিশু সন্তান আফিফা ও তাফিমাকে নিয়ে বর্হিবিভাগের সামনেই দাঁড়িয়ে রয়েছেন শিশুদের হতভাগ্য বাবা সাইফুল ইসলাম। মুখে সমস্যা ও কানের ব্যাথা জনীত কারনে তার সন্তানদের নিয়ে হাসপাতালে এসেছেন সদর উপজেলার ইলিশা ইউনিয়নের পশ্চিম ইলিশা গ্রামের দিনমজুর সাইফুল। হাসপাতালের ওষুধ বিভাগটি খোললেও দায়িত্বরতরা তাদের কাজ এখানো শুরু করেননি। জানতে চাওয়া হলে তানজিল নামের হাসপাতালের ওষুধ বিভাগের দায়িত্বরত এক ওয়ার্ড বয় বললেন, সকাল ৮টা থেকেই টিকিট কাউন্টারের ডিউটি। ওই সময়েই সব বিভাগ খুলে যাওয়ার কথা। সকাল ৯টা থেকে তাদের কাজ শুরু হওয়ার কথা। তিনি আরো বলেন, স্যারেরা (চিকিৎসকরা) হাসপাতালে বসতে দেরি করেন তাই হয়তো টিকিট কাউন্টারের দায়িত্বরতরাও দেরি করছেন। এদের মধ্যে টিকিট কাউন্টারের দায়িত্বরত টিকিট কার্ক ( টিকিট কেরানি) সহিদ খান এসে টিকিট কাউন্টার খুলে দেন সকাল ৯টায়। তবে, তিনি সকাল ৮টায় আসার কথা দাবি করে বলেন, আমি সকাল ৮টার দিকে হাসপাতালে এসে বায়োমেট্রিক এন্ট্রি করেছি। কিন্তু হাসপাতালের লোক খেদাতে হয় (রোগীর স্বজনদের ভির সামাল দিতে হয়)। তাই টিকিট কাউন্টার খোলতে দেরি হয়। অপর টিকিট কার্ক আব্দুল কাদের আসেন সকাল ৯টা ১৭ মিনিটে। তারা দুজনের কেউই সময়মত টিকিট কাউন্টার খোলেননা।
এদিকে টিকিট কাউন্টারের লোক, চিকিৎসক কিংবা হাসপাতালের অন্যান্য ষ্টাফ সময়মত না আসলেও বিভিন্ন বেসরকারি কিনিক, ডায়াগনষ্টিক সেন্টার ও ওষুধের ফার্মেসির দালালরা ঠিকই হাসপাতালে চলে আসেন সকাল ৮টার আগেই।
সকাল ৯টার দিকে সরেজমিনে জরুরী বিভাগে গিয়ে দেখা গেছে, রোগীদের পাশাপাশি জিহাদ নামের একজন ওষুধের দোকানি হাসপাতালে অবস্থান করছেন। তিনি এক রোগী নিয়ে জরুরী বিভাগ থেকে হাসপাতালের ভেতরে চলে যাচ্ছেন। জানতে চাওয়া হলে ওষুধের দোকানি জিহাদ বলেন, রোগী আমার এক আত্মীয়। তাই তাকে সহায়তা করছি। প্রায় এক ঘন্টা পর সকাল ১০টার দিকে আরেকজন রোগী নিয়ে ফের হাসপাতালে ঢোকেন জিহাদ। সেই রোগীও কি আপনার আত্মীয়? এমন প্রশ্নের উত্তরে দালাল খ্যাত ওষুধ দোকানি জিহাদ বলেন, সে আমার এলাকার পরিচিত। সেন্টু নামের অপর দালাল চাকুরি করেন এ্যাপোলো ডায়াগনষ্টিক সেন্টারে। তিনিও বেশ কয়েকজন রোগীকে বাগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন তাদের এ্যাপোলো ডায়াগষ্টিক সেন্টারে। দৌলতখান উপজেলার চরপাতা ইউনিয়নের কাজীরহাট গ্রামের দিনমজুর ইউসুফের ছেলে বাবুলকে নিয়ে হাসপাতালে আসেন তার মা শাহনাজ বেগমসহ তার স্বজনরা। এ্যাপোলো ডায়াগষ্টিক সেন্টারের কর্মচারি সেন্টু রোগীকে ডাঃ মাকসুদের কাছে নিয়ে তার কাছ থেকে একটি ব্যবস্থাপত্র নিয়ে চলে যেতে বলেন এ্যাপোলো ডায়াগষ্টিক সেন্টারে। সেই রোগীর স্বজনরা সেন্টুর কথামত হাসপাতাল রোডে নির্মিত এ্যাপোলো ডায়গনষ্টিক সেন্টারে গিয়ে ৮০০টাকা দিয়ে এক্স-রে করান।
এ ব্যাপারে রোগী বাবুলের মা শাহনাজ বেগম বলেন, সেন্টু নামের এক লোক আমাদেরকে জানান, হাসপাতালের এক্স-রে মেশিন ভালোনা। এটাতে এক্স-রে করা হলে কিছু দেখা যায়না। তাই তার কথামত এ্যাপোলো ডায়গনষ্টিক সেন্টারে গিয়ে ৮০০টাকা দিয়ে এক্স-রে করিয়েছি। অথচ এক্স-রে ইনচার্জ মীর মোঃ আতিকুল ইসলাম কালের কন্ঠকে বলেন, হাসপাতালের এক্স-রে মেশিন ভালো রয়েছে। তিনি আরো বলেন, যেসব রোগীরা এক্স-রে করতে আসেন তাদেরকে এক্স-রে করানো হচ্ছে। আমি অনেক সময় মাইকিং করেও রোগীদেরকে এক্স-রে করানোর কথা বলে দিচ্ছি। কিন্তু হাসপাতালের দালালরা রোগীদেরকে মিথ্যা কথা বলে এবং ভুল-বাল বুঝিয়ে বিভিন্ন বেসরকারি কিনিক ও ডায়গনষ্টিক সেন্টারে নিয়ে যাচ্ছেন। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত এ্যাপোলো ডায়াগষ্টিক সেন্টারের কর্মচারি সেন্টুকে হাসপাতালের বর্হিবিভাগ ও অন্তঃবিভাগে ঘোরাঘুরি করতে দেখা গেছে। এ সময় সেন্টুকে রোগী, রোগীর স্বজন, হাসপাতালের বেশ কয়েকজন ষ্টাফদের সঙ্গে আলাপসহ তাদের সঙ্গে তামাসা করতেও দেখা যায়। সেন্টু জানান, তিনি প্রায় প্রতিদিনই এ হাসপাতালে আসেন। তিনি আরো বলেন, আমি যেহেতু এ্যাপোলো ডায়গনষ্টিক সেন্টারে চাকুরি করি সেহেতু কোন না কোন কারনে আমাকে প্রতিদিন হাসপাতালে আসতে হচ্ছে।
সকাল পৌনে ১১টার দিকে হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডাঃ তৈয়বুর রহমান যখন পুরুষ মেডিসিন বিভাগে অন্তঃবিভাগের রোগী দেখছিলেন, তখনও দালাল এ্যাপোলো ডায়াগষ্টিক সেন্টারের কর্মচারি সেন্টুকে সেখানে অবস্থান করতে দেখা গেছে। জরুরী বিভাগের দায়িত্বরত চিকিৎসক ডাঃ শরিফুল ইসলামের কক্ষেও দেখা গেছে ১০-১২ জন দালালদের দৌরাত্ম। জরুরী বিভাগের দায়িত্বরত সিনিয়র ষ্টাফ নার্স মতিউর রহমান বলেন, হাসপাতালে দালালদের দৌরাত্ম অনেক বেড়েছে। প্রতিনি ১০-১২ জন দালাল হাসপাতাল ঘিরে রাখে। তিনি আরো বলেন, বিভিন্ন বেসরকারি কিনিক, ডায়াগনষ্টিক সেন্টার ও ওষুধের ফার্মেসির দালালরা স্থানীয় ও প্রভাবশালী ব্যাক্তি। আর আমরা সামান্য চাকুরিজীবী। আমাদের কোন নিষেধ দালালরা মানতে চায়না। তাদেরকে কিছু বললে আমাদের মত সামান্য ষ্টাফদের দিকে তেড়ে আসে। অনেক সময় মারধরও করে থাকে। দালালদেরকে প্রতিরোধ করতে গিয়ে অনেক সময় হাসপাতালের ষ্টাফরা হামলার শিকার হয়েছেন। এখন দালালদের ভয়ে কেউ কিছু বলতে সাহস পাচ্ছেনা। এক রকম দালালদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে ১০০ শয্যা বিশিষ্ট ভোলা সদর হাসপাতালের রোগী, চিকিৎসক ও ষ্টাফ।
জিহাদ ও সেন্টুর মত বহু দালাল প্রতিদিন ভোলা সদর হাসপাতালে এসে বিভিন্ন প্রভাব খাটাচ্ছে। এতে করে অনেক সময় রোগীরা প্রতারিত হচ্ছেন। দরিদ্র রোগীরা বিনে পয়সার হাসপাতালে সেবা পাচ্ছেননা। গুনতে হচ্ছে মোটা অংকের অতিরিক্ত টাকা। অনেকটা অসহায় হয়ে পড়ছেন হাসপাতালে কর্মরত চিকিৎসক ও ষ্টাফরা।
ভোলা সদর হাসপাতালে দালালদের দৌরাত্মের কথা স্বীকার করে সিভিল সার্জন ডাঃ রথীন্দনাথ মজুমদার বলেন, দেশের সব হাসপাতালেই যেমন দালালদের উপদ্রব আছে। তেমনি ভোলা সদর হাসপাতালেও দালালদের উপদ্রব আছে। হাসপাতালটি দালালমুক্ত নয়। তবে, হাসপাতাল দালালমুক্ত করতে আমরা নানমূখী পদক্ষেপ নিয়েছি। হাসপাতালের দেয়ালে দেয়ালে স্টিকার লাগিয়েছি। অভ্যর্থনা কক্ষ তৈরী করা হয়েছে। এ ছাড়া রোগীর সেবার জন্য ভিন্ন একটি কক্ষ করা হচ্ছে। যাতে করে যে কোন রোগী যে কোন সেবা পেতে কোথায় যেতে হবে তা সহজেই জানতে পারেন।

বাংলাদেশ সময়: ১৩:২২:০৯   ২২১ বার পঠিত  |




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

প্রধান সংবাদ’র আরও খবর


ভোলা সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচন-২০২৪ভোলায় দুই চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থকদের সংঘর্ষে আহত ২৫
গাজায় ইসরায়েলি হামলায় ৩৪৬২২ ফিলিস্তিনি নিহত
মুজিব শতবর্ষে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন পুরনে একধাপ এগিয়ে মনপুরায় বঙ্গবন্ধুর চিন্তানিবাস পর্যটন কেন্দ্রস্থান সচিবের পরিদর্শন ॥
শ্রেষ্ঠ মাদ্রাসা অধ্যক্ষ নির্বাচিত হলেন মুফতি মাও: মুজির উদ্দিন
চাহিদার চেয়ে উৎপাদন ক্ষমতা বেশি থাকলেও ভোলায় লোডশেডিং ও বিদ্যুৎ বিভ্রাট থেকে মুক্তি পাচ্ছেন না গ্রাহকরা।
লালমোহনে জাগোনারী’র অবহিতকরণ সভা অনুষ্ঠিত
দুই মাসের নিষেধাজ্ঞার পর ভোলায় মধ্যরাত থেকে মাছ শিকারে নামবেন জেলেরা
ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেবে আরও ইউরোপীয় দেশ
তজুমদ্দিনে ৮৫৬টি গাছ কেটে রাস্তা চওড়া করার প্রস্তুতি সম্পন্ন ,স্থানীয়দের ক্ষোভ
ভোলায় ডিবির অভিযানে অস্ত্রসহ ৩ দস্যু আটক, অপহৃতরা উদ্ধার

আর্কাইভ