ভোলার ভাষাসৈনিক চুন্নু মিয়ার নামে স্বাধীনতার ৫০ বছরেও রাষ্ট্রীয় স্মৃতিচিহ্ন নেই

প্রথম পাতা » ব্রেকিংনিউজ » ভোলার ভাষাসৈনিক চুন্নু মিয়ার নামে স্বাধীনতার ৫০ বছরেও রাষ্ট্রীয় স্মৃতিচিহ্ন নেই
বুধবার, ৩১ মার্চ ২০২১



গাজী মো. তাহেরুল আলম || মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, দ্বীপজেলা ভোলার একমাত্র ভাষাসৈনিক, সাবেক এমপি মরহুম রেজা-এ করিম চৌধুরী চুন্নু মিয়ার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃ়তি মেলেনি স্বাধীনতার সূবর্ণজয়ন্তীর ৫০ বছর পেরুলেও।

 

স্বাধীনতা যুদ্ধে যাঁদের আন্দোলন-সংগ্রামের কারণে দেশ আজ স্বাধীন হয়েছে তাঁদের অনেকেই অবহেলিত।সরকার প্রতিশ্রুতি দিলেও মূল্যায়ণ হয়নি সংগ্রামী এসব বীরদের। আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় আটকে আছে এঁদের স্বীকৃতি।তেমনি একজন ভাষাসৈনিক মরহুম রেজা-এ করিম চৌধুরী চুন্নু মিয়া। যাঁর স্মরণে এখনো নেই কোনো রাষ্ট্রীয় স্মৃতিচিহ্ন। নির্মিত হয়নি কোন স্থাপনা।

 

ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার কুতুবা ইউনিয়নের ঐতিহ্যবাহী ও সম্ভ্রান্ত পরিবার আব্দুল জব্বার মিয়া বাড়িতে ১৯৩১ সালে জন্মগ্রহণ করেন মহান এ ভাষা সৈনিক রেজা-এ-করিম চৌধুরী চুন্নু মিয়া। তিনি ১৯৭০ সালের নির্বাচনে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য (এমএলএ) নির্বাচিত হন। ছিলেন ভোলার মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক। এ ছাড়া স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন মরহুম ভাষা সৈনিক চুন্নু মিয়া। স্বাধীনতার আগে ও পরে ২ বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলেও রেজা-এ-করিম চৌধুরী চুন্নু মিয়া মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সাদাসিদে জীবন যাপন করেছেন। তিনি বিনা বেতনে শিক্ষকতা করেছেিলেন বোরহানউদ্দিন মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও আব্দুল জব্বার কলেজে। বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক ও কর্মজীবনের অধিকারী এ ভাষা সৈনিক চুন্নু মিয়া ২০০৭ সালের ২ মার্চ শুক্রবার মৃত্যুবরন করেন।

 

ভোলার তৎকালীন জেলা প্রশাসক ও বর্তমান সেতু সচিব বেলায়েত হোসেন বরাবর ভাষা সৈনিক রেজা-এ-করিম চৌধুরীচুন্নু মিয়ার স্মৃতি সংরক্ষণের দাবি সম্বলিত একটি স্মরকলিপি দেন এলাকাবাসী। কিন্তু দাবি বাস্তবায়নের আশ্বাস পাওয়া গেলেও এখনও তা অধরা রয়ে গেছে। মহান এ ভাষা সৈনিকের নামে একটি আধুনিক তোরণ  নির্মাণেরও আশ্বাস দিয়েছিলেন স্থানীয় এমপি। কিন্তু বাস্তবায়ন হয়নি আজো। দেরিতে হলেও ভাষা সৈনিক রেজা-এ-করিম চৌধুরী চুন্নু মিয়ার স্বীকৃতি ও স্মৃতি সংরক্ষণের দাবি দ্বীপ জেলার সচেতন মহলের।

 

চুন্নু স্যার নামে সমধিক পরিচিত মরহুম রেজা-এ-করিম চৌধুরীর ব্যক্তিগত ডায়েরি ও ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস থেকে জানা যায়, তিনি ঢাকা কলেজে অধ্যয়ন করার সময় মাত্র ১৯ বছর বয়সে ভাষা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েছিলেন। ১৯৫২ সালে জিন্নাহর রাষ্ট্র ভাষা উর্দূ ঘোষণার পর তার মধ্যে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠল। তখন তিনিসহ তার এক সহপাঠীরা তাৎক্ষণিকভাবে ঢাকা কলেজের ভিপি ইকবাল আনসার হেনরীর সঙ্গে যোগাযোগ করে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে একাত্বতা ঘোষণা করে ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন।

---

তাঁর ডায়রি থেকে আরো জানা যায়, ১৯৫২ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান সরকার অপরাহ্নে ঢাকা শহরে ১৪৪ ধারা জারি করে। ছাত্র প্রতিনিধিরা আগেই ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। চুন্নু মিয়ার ভাষায়, আমরা জানতাম ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিলে গেলে নিশ্চিত গুলি হবে। তারপর ও মায়ের ভাষার প্রতি অপরিসীম ভালবাসা আমাকে মিছিলে যেতে উদ্বুদ্ধ করেছে। হঠাৎ মনে পড়ে আমি যদি আগামীকাল মিছিলে গিয়ে গুলিতে শহীদ হই তাহলে আমার লাশের সন্ধান হয়তো আত্মীয়রা পাবে না। এই কথা ভেবে আমি রাতে বসেই আমার পুরো নাম ঠিকানা সাদা কাগজে লিখে পকেটে ঢুকিয়ে রাখলাম। যাতে এই ঠিকানা অনুযায়ী আমার লাশ অন্তত: স্বজনদের কাছে পৌঁছে দিতে পারে।

বায়ান্ন’র ২১ ফেব্রুয়ারি ভোর থেকেই ছাত্র নেতৃবৃন্দের পরামর্শ অনুযায়ী ৮/১০ জনের খণ্ড মিছিল শুরু হল। তাদের কলেজের তৃতীয় ব্যাচের মিছিলে ছিলেন তিনি। মিছিল যখন কলাভবনের কাছে পৌঁছল তখন তাকে সহ অনেককে আটক করে পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়ে যায়। রাতে তাদের ফাঁড়িতে অবস্থান করতে হয়। সকালে পুলিশ তাকে সহ অন্যদের পুলিশ ভ্যানে করে কোর্টে নিয়ে যায়। কোর্টে হাজির না করেই এক ঘণ্টার মধ্যে তাদের কেন্দ্রীয় কারাগারে নেয়া হল। এরপর এক মাস কারাভোগের পর ২১ মার্চ মুক্ত আকাশের চোখ দেখেন।

 

১৯৭১ সালে চুন্নু মিয়া ভোলার মুক্তিযোদ্ধাদের সুসংগঠিত করে স্বাধীনতা যুদ্ধে অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭০ সালে চুন্নু মিয়া আওয়ামী লীগ থেকে এমএলএ নির্বাচিত হয়েছিলেন। ওই সময় তিনি নিজেকে জনপ্রতিনিধি হিসেবে সীমাবদ্ধ রাখেননি একাধারে ৪ টি স্কুলের শিক্ষকতার পাশাপাশি শুধু গ্রাজুয়েট হয়েও আব্দুল জব্বার কলেজে শিক্ষকতা করেন। ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের তার লেখা বই “অনন্য সাধন” সবার প্রশংসা পেয়েছে কিন্তু “খেকশিয়ালের অধ:পতন” পান্ডুলিপি তার জীবদ্দশায় প্রকাশ করে যেতে পারেননি।

 

স্বীকৃতি ও স্মৃতি সংরক্ষণের ব্যাপারে চুন্নু মিয়ার বড় ছেলে কবির চৌধুরী ও ছোট ছেলে মাহাবুব-উল-আলম চৌধুরী বলেন, বাবার মুখে আমরা ভাষা আন্দোলনের সেই গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকার কথা শুনেছি। ওই সময় তিনি স্বীকৃতি, স্মৃতি সংরক্ষণ হবে বা হবে না এ চিন্তা করে আন্দোলনে যোগ দেননি। মায়ের ভাষা বাংলার জন্য আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন। এখন রাষ্ট্র যদি মনে করে এটা প্রয়োজন তাহলে ১৯৫২ সালের জেল রেকর্ড তলব করলেই ঘটনার সুরাহা হয়।

 

উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এখনো আশ্বস্ত করা হচ্ছে বিষয়টি নিষ্পত্তির। বোরহানউদ্দিন উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো. সাইফুর রহমান জানিয়েছেন ঊধ্বর্তন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তিনি আলোচনা করবেন।

 

এদিকে বোরহানউদ্দিন পৌরসভার মেয়র মো. রফিকুল ইসলাম ঘোষণা দিয়েছেন অচিরেই ভাষাসৈনিক চুন্নু মিয়ার নামে নব-নির্মিত একটি সু-পরিসর সড়কের নামকরণ করা হবে।

 

ভোলা-২ (বোরহানউদ্দিন-দৌলতখান) আসনের সংসদ সদস্য আলী আজম মুকুল জানান, চুন্নু স্যার আমার প্রিয় শিক্ষক। স্যারের নামে বোরহানউদ্দিন উপজেলার প্রবেশদ্বারে একটি সুদৃশ্য তোরণ নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। কিন্তু ভোলা-চরফ্যাশন সড়ক প্রসস্থকরণ পরিকল্পনার পর ওই উদ্যোগ স্থগিত করা হয়। সড়ক প্রসস্থকরণের পরপরই বোরহানউদ্দিন উপজেলার প্রবেশ দ্বারে তোরণ নির্মাণ হবে।

বাংলাদেশ সময়: ৯:৪৯:২৬   ৬৬ বার পঠিত  |




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

ব্রেকিংনিউজ’র আরও খবর


ভোলায় ইসতিসকার নামাজ আদায়
চরফ্যাসনে হিটস্ট্রোকে যুবকের মৃত্যু
ভোলায় তীব্র প্রবাহে অস্থির জনজীবন
ভোলা সদর উপজেলা নির্বাচন ২০২৪আপনাদের পবিত্র ভোট ৫ বছরের জন্য ভাল পাত্রে জমা রাখবেন-মোহাম্মদ ইউনুছ
দেশ ভাঙার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত কংগ্রেস: নরেন্দ্র মোদি
লালমোহনে সাংবাদিকদের সাথে উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীর মতবিনিময়
লালমোহনে আবাসনের ঘর জবরদখলের অভিযোগ
উপজেলা পরিষদ নির্বাচন ২৪ভোলার ৩ উপজেলায় ৩৮ প্রার্থীর মনোনয়ন পত্র দাখিল
প্রচণ্ড গরমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটি ঘোষণা
শশীভূষণে পানিতে ডুবে দুই সহোদরের মৃত্যু

আর্কাইভ