মনপুরা হাসপাতালকে বদলে দিলেন ইত্যাদির সেই ডা. মাহমুদুর রশিদ

প্রথম পাতা » প্রধান সংবাদ » মনপুরা হাসপাতালকে বদলে দিলেন ইত্যাদির সেই ডা. মাহমুদুর রশিদ
শনিবার, ১৯ আগস্ট ২০১৭



শিমুল চৌধুরী: ।।ভোলাবাণী।।

---উপকূলীয় দ্বীপ জেলা ভোলার লালমোহন হাসপাতাল বদলে দিয়ে এবার বিচ্ছিন্ন দ্বীপ উপজেলা মনপুরা হাসপাতালকে বদলে দিয়েছেন ডাঃ মাহমুদুর রশিদ। মনপুরাতে যারা হাসপাতাল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন তাঁরা আবার হাসপাতালে আসছেন সেবা নিতে। তিনি এসে চালু করেছেন হাসপাতালের উন্নত পরিবেশ ও সু চিকিৎসা সহ জল-অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস। যা ওই উপজেলার ইতিহাসে বিরল ঘটনা।
মনপুরা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পণা কর্মকর্তা ডা. মাহমুদুর রশিদ মনপুরায় আসেন ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। তিনি ইতিমধ্যে মেডিক্যাল অফিসার হিসাবে কাজ করেছেন প্রায় ১৫ বছর। লালমোহন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যোগ দিয়েছিলেন ২০০৬ সালের নভেম্বর মাসে। তারপরই হাসপাতাল পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযানে নামেন তিনি। নিয়েছেন বিভিন্ন পদক্ষেপ। এ নিয়ে রোগীদেরকে যেমন সচেতন করতেন, হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারিদের সঙ্গেও বৈঠক করতেন। একপর্যায়ে সফলও হন পরিশ্রমী এ চিকিৎসক। তবে, এর জন্য সময়ও লেগেছে অনেক। তার এসকল চিত্র তুলে ধরে বাংলাদেশের জন প্রিয় ইত্যাদি অনুষ্ঠানেও।

মনপুরা একেবারে বিচ্ছিন্ন

জেলা সদর থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন দ্বীপ উপজেলা মেঘনার চর মনপুরা। এক লাখ মানুষ বাস করে এখানে। প্রাকৃতিক দিক দিয়ে খুব সুন্দর। কিন্তু মানুষ আধুনিক সুযোগ সুবিধা পায় না। জলপথেই যার যোগাযোগ। শিক্ষার হার খুব কম। মানুষ সরকারি সেবাগুলোও নিতে পারছে না। ডাঃ মাহমুদুর রশিদ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পণা কর্মকর্তা হিসাবে যোগদানের পর দেখেন রোগীশুণ্য হাসপাতাল। এখানে কোন রোগী আসছেনা। তিনি বুঝতে চাইলেন, কেন মানুষ হাসপাতালে আসে না? হাট-বাজারে ঘুরতে লাগলেন। চায়ের দোকানেও গল্প জমাতেন। মানুষজন বলল, ‘হাসপাতালে গিয়ে ডাক্তার পাই না। নার্স থাকে না। ওষুধ নাই। অথচ ভিজিট দিতে হয়।’ তিনি ঘরে ফিরে এসে একটি বোর্ড টাঙানোর কথা ভাবলেন। আর তাতে লেখা হলো, হাসপাতালে কোনো ফি লাগে না। তারপর ভাবলেন হাসপাতালের সামনে একটা সুন্দর ফুলের বাগান করার কথা। সেই সঙ্গে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, শিক্ষক ও সাংবাদিকদের নিয়ে সভা করতে লাগলেন।

২৯ মার্চ কাল রাত

২০১৬ সালের ২৯ মার্চ। রাত এগারটা কি বারটা। অনেক মানুষের পায়ের আওয়াজ শুনতে পেলেন ডাঃ মাহমুদুর রশিদ। দোতলায় হাসপাতালের লেবার ওয়ার্ডে দৌড়ে গেলেন তিনি। দেখেন ২২-২৩ বছর বয়সী একটা মেয়ে প্রসব বেদনায় কাতরাচ্ছে। তার বাড়ি চর ফয়জুদ্দিন। দূরের পথ। রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। তিনি তখন অসহায় ছিলেন। উপায় করতে পারেননি কিছু। ঝর্ণা নামের সেই মেয়েটা তার সামনেই রক্তক্ষরণে মারা গেল। তার চোখ দিয়ে পানি চলে এসেছিল।

জারি গানের দল

---ওই মার্চেই একটি জারি গানের দল করার কথা ভাবলেন ডাঃ মাহমুদুর রশিদ। দলনেতা করা হলো স্থানীয় শিল্পকলা একাডেমীর শিক্ষক জুরান বাবুকে। দলে নাম লেখাল বিণাপানি দাস, স্বপন বাবু আর বৈশাখী। প্রথম গানটির কথা ছিল এমনÑসুস্থ শিশুর জš§ মোরা চাই, সময়মত সিদ্ধান্ত নিতে হবে তাই। হাটে, মাঠে, ঘাটে দলটি গান গেয়ে বেড়াতে থাকল। লোকে তাদের ওপর বিশ্বাস রাখতে শুরু করল। এর পর রোগীদের হাসপাতাল মুখি করতে বিভিন্ন গ্রাম ও হাট বাজারে গিয়ে নিজেই বাওল সেঝে তরুণ তরণী নিয়ে গান পরিবেশন করে হাসপাতাল মুখি করেন।

হাসপাতালটি ৩১ শয্যাবিশিষ্ট

মনপুরা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পণা কর্মকর্তা ডাঃ মাহমুদুর রশিদ জানান, আগে হাসপাতালে রোগী ভর্তি হতে আসত না। এখন কোনো কোনোদিন ৭০-৮০ জনও চলে আসে। হাসপাতালে এখন ৪ জন মেডিকেল অফিসার, ৮ জন নার্স, ৫ জন পরিচ্ছন্ন কর্মী কাজ করছেন। এখনো এখানকার অবকাঠামো উন্নত নয়। বিদ্যুৎ সুবিধাও পাওয়া যাচ্ছেনা সেরকম। কিন্তু কর্মীরা সকলে আন্তরিক। সেবা দেওয়ার মন তৈরি হয়েছে সবার। ওয়ার্ডবয়, কুকরাও পিছিয়ে থাকছে না কাজে। কোনো কাজ করার আগে আমরা সবাই মিলে পরিকল্পণা করি। গেল ঈদের রাতেও আমরা ৩ জন প্রসূতি মাকে শুশ্রƒষা দিয়েছি। গত চার মাসে আমরা সবমিলিয়ে ৬২ জন গর্ভবতীকে প্রসবকালিন দিয়েছি। আমাদের হাসপাতালে এখন পুষ্টি কর্নার, ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার সচল আছে। সক্রিয় আছে এনএসডি (নরমাল স্পন্টেনিয়াস ডেলিভারি) কর্নারও। আমাদের একটি আধুনিক ল্যাব আছে এখন। নবজাতকের যতœ নিতেও আমরা এখন সমর্থ। রোগীকে অক্সিজেন দেওয়ার মেশিন আছে এখন মনপুরায়। রোগীর দেহে রক্ত সঞ্চালনের কাজও আমরা করতে পারছি। তিনি বলেন, আহা যদি ঝর্নার সময় ব্যাবস্থাটি থাকত! তাহলে আমার সামনে মেয়েটির অন্তত প্রাণ যেতনা।

এপিজে আবুল কালাম শিলংয়ে বলে ছিলেন

ডাঃ মাহমুদুর রশিদ বলেন, ভারতের প্রয়াত প্রেসিডেন্ট এপিজে আবুল কালাম শিলংয়ে বক্তব্য রেখে ছিলেন মারা যাওয়ার দিনই। হৃদয়ের সৌন্দর্য প্রকাশ করার কথা বলেছিলেন সেদিন। হৃদয়ের সৌন্দর্য প্রকাশে আমিও ব্যাকুল থাকি। পরিবার থেকে আমি যথেষ্ট সমর্থন পাই। আমার স্ত্রী-সন্তানরাও সহজ সরল জীবনযাপনে অভ্যস্ত। আমি মনপুরা ভালোবাসি মনে প্রাণে। সহযোগিতা পেয়েছি ভোলার জেলা প্রশাসক মোহাং সেলিম উদ্দিনের কাছ থেকে। ভোলার সাবেক সিভিল সার্জন ডাঃ ফরিদ আহম্মেদকেও ধন্যবাদ জানাই। এখনকার সিভিল সার্জন ডাঃ রথীন্দ্রনাথ মজুমদারের কথাও বলতে হয়। বলছি আইসিডিডিআরবির চীফ সাইনটিষ্ট ডাঃ ইকবাল আনোয়ারের কথাও। তিনি বিশাল এক টিম নিয়ে ২০১৬ সালের ২ অক্টোবর মনপুরায় একটি স্বাস্থ্য সম্মেলন করেছিলেন। আমি কৃতজ্ঞ স্বাস্থ্য বিভাগের ডাক্তার ইমদাদুল হকের কাছে। মনপুরার ১৭ মাসের জীবনে আমি পাঁচজন প্রসূতি মায়ের মৃত্যু দেখেছি। আমি আর এমন মৃত্যু প্রত্যাশা করি না।

অবশেষে জল অ্যাম্বুলেন্স

---ডাঃ মাহমুদুর রশিদ বলেন, প্রসুতি মায়ের মৃত্যু বিষয়টি নিয়ে আমি ডাঃ ইমদাদুল হকের কাছেই প্রথম যাই। জল অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে কথা বলি। তিনি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রনালয়ের যুগ্ম সচিব শফিকুল হকের সঙ্গে আলাপ করেন। ওই মন্ত্রণালয়েরই আরেক যুগ্ম সচিব আনোয়ার হোসেন ২০১৭ সালের ২ ফেব্রুয়ারী সরকারি সফরে মনপুরায় আসেন। তার কাছে জল অ্যাম্বুলেন্সের দাবী তুললাম। তিনি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলেন। তাঁরই তৎপরতায় ১২ লাখ টাকা ব্যায়ে নির্মিত হয় একটি ডিজেলচালিত জল অ্যাম্বুলেন্স। আমরা এখন মুমূর্ষু রোগীকে দ্রুত ভোলা সদর হাসপাতালে নিয়ে যেতে সক্ষম হচ্ছি।
জল অ্যাম্বুলেন্সটির পরিবহন খরচ কম। মনপুরা থেকে তজুমোদ্দিন সর্ব্বোচ ২০০০/- টাকা। রোগী পরিবহনে অক্সিজেন সরবরাহসহ প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার ব্যব্যস্থা আছে। রোগীর কেবিনে ২টি বেড দেওয়া আছে। আছে লাইভ জ্যাকেট ও লাইভ বয়া।
---বৈড়ি আবহাওয়া ছাড়া সব সময় রোগী পরিবহনে সক্ষম। দূর্গম চরকলাতলি, ঢালচর ও চরনিজামের রোগীরা এই এ্যাম্বুলেন্স এর মাধ্যমে আমাদের সেবার আওতায় চলে আসে। যান্ত্রিক ত্রুটি স্থানীয় ভাবে মেরামত যোগ্য। রোগীসহ ১০ জন মানুষ পরিবহন করা যায়।

বাংলাদেশ সময়: ১৯:৫৪:৫২   ১১৪৩ বার পঠিত  |




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

প্রধান সংবাদ’র আরও খবর


৬ষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচন ২৪মনপুরায় উপজেলা চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী ৫ জন ॥ মোট প্রার্থী ১১ জন
তজুমদ্দিনে আগুনে পুড়ে ১৩ দোকান ছাই পাঁচ কোটি টাকা ক্ষতি ॥
এসএসসির ফল প্রকাশের সম্ভাব্য তারিখ ঘোষণা
এ কে ফজলুল হককে কেন ‘শেরে বাংলা’ বলা হয়?
জাতীয় পর্যায়ের লোকনৃত্য প্রতিযোগীতায় ভোলার মেয়ে স্বস্তিকার ২য় স্থান অর্জন
ভোলায় ইসতিসকার নামাজ আদায়
চরফ্যাসনে হিটস্ট্রোকে যুবকের মৃত্যু
ভোলায় তীব্র প্রবাহে অস্থির জনজীবন
গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য কাচারি ঘর বিলুপ্তির পথে ॥
ভোলা সদর উপজেলা নির্বাচন ২০২৪আপনাদের পবিত্র ভোট ৫ বছরের জন্য ভাল পাত্রে জমা রাখবেন-মোহাম্মদ ইউনুছ

আর্কাইভ