সমুদ্রের সাথে মনপুরার জেলেদের জীবন যাত্রা ॥ জেলেদের দিন কাটে দুঃখ কষ্টে

প্রথম পাতা » প্রধান সংবাদ » সমুদ্রের সাথে মনপুরার জেলেদের জীবন যাত্রা ॥ জেলেদের দিন কাটে দুঃখ কষ্টে
শুক্রবার, ২৫ আগস্ট ২০১৭



---মোঃ ছালাহউদ্দিন ।।ভোলাবাণী।। মনপুরা সংবাদদাতা॥ ভোলার রুপালী দ্বিপ মনপুরায় ৭০ ভাগ মানুষ প্রতক্ষ ও পরোক্ষভাবে মৎস্য সম্পদের উপর নির্ভশীল। ইলিশের মৌসুম আসার আগ দিয়ে এই অঞ্চলে শুরু হয়ে যায় জাল,নৌকা ও ট্রলার বানানোর হিড়িক। এখানকার জেলেরা অত্যন্ত গরীব। জাল,নৌকা বা ট্রলার বানানোর মতো আর্থিক সামর্থ্য অধিকাংশ জেলের বা মাঝির নেই। তারা বাধ্য হয়ে মহাজন বা আড়তদারদের নিকট থেকে নগদ টাকা দাদন নিয়ে জাল বা ট্রলার তৈরি করেন। কমিশনের আশায় আড়তদার জেলে মাঝি ,নৌকা বা ট্রলার মালিকদের দাদন দিয়ে থাকেন। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জেলেরা মেঘনায় বা সাগরে ইলিশ মাছ শিকার করতে যায়। সমুদ্রের সাথে জেলেদের নিবিড় সম্পর্ক থাকে।

মাঝিদের সাথে আড়তদারদের চুক্তি ঃ
চক্তি থাকে যেসব নৌকা বা ট্রলার মালিক আড়তদারদের কাছ থেকে দাদন নিয়ে মাছ শিকার করে সেসব নৌকা বা ট্রলারের মাছ সেই আড়তদারদের কাছেই বিক্রি করতে হবে। দাদন দেয়া আড়তদার ছাড়া অন্য কারো কাছেই বিক্রি করতে পরবেনা। জেলেরা রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে দিনরাত মেঘনায় বা সাগরে মাছ শিকার করে । জেলেরা মাছ শিকার করে দাদন ব্যাবসায়ীদের মতস্য আড়তে মাছ বিক্রির জন্য আসেন। তখন ডাকে যত টাকার মাছ বিক্রি হয় তত টাকার বিক্রির উপর আড়তদার শতকরা ১০-১৫ টাকা হারে কমিশন পায়। কিন্তু এতে জেলেদের দাদন পরিমান কমেনা। জেলেদের দাদন দেওয়ার কারনে বাধ্য হয়ে জেলেরা আড়তদারদের কাছে মাছ বিক্রি করতে হয়। সেই সঙ্গে তাকে গুনতে হয় কমিশন। মেঘনায় মাছের আকাল থকলেও আড়তদারদের কমিশন বন্ধ হয়না।

জেলে পেশায় জড়িত ঃ
প্রতক্ষ ও পরোক্ষভাবে অধিকাংশ মানুষ জেলে পশোয় জড়িত। বিশেষ করে জেলে পরিবারের অধিকাংশ ছেলে ৮-১০ বছর বয়সে সংসারের অভাবের তাড়নায় এ কাজে জড়িয়ে পড়েন। পিতা মাতা ছেলেদের মাছ ধরার কাজে উৎসাহিত করেন। ্এতে দেখা যায় জেলে পরিবারের অধিকাংশ ছেলে স্কুল পড়াশুনা বাদ দিয়ে মেঘনায় মাছ শিকার করে। শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত জেলে পরিবারের মধ্যে দেখা যায় একজন জেলের আয়ের উপর ৭-৮ জনের সংসার চলে।

ঝুঁকি নিয়ে মাছ শিকার ঃ
সংসারের অভাবের তাড়নায় পরিবারের ভরন পোষন জোগার করতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মেঘনায় বা সাগরে ইলিশ মাছ ধরতে যায় জেলেরা। বন্য ঝড় ঝলোচ্ছাস কিছুই তাদের আটকে রাখতে পারেনা। ছেলে সন্তানের দিক তাকিয়ে জীবন বাজি রেখে সাগরে মাছ ধরতে যায়। আবার ফিরে আসবে কিনা তাও তারা জানেনা। অনেক জেলেকে আবার সাগরে প্রান দিতেও দেখা গেছে। প্রতিবছর সাগরে ইলিশ মাছ ধরতে গিয়ে জেলের প্রান যাচ্ছে। জলদস্যুদের তান্ডবে জেলেরা মাছ শিকার করতে সাহস পাচ্ছেনা। জলদস্যুদের গুলিতে অনেক জেলের প্রান দিতেও দেখা গেছে। তবুও থেমে নেই জেলেরা।

কিভাবে যায় সাগরে ঃ
সাগরে মাছ ধরার জন্য প্রতিটি ফিসিং বোটে ১৫-২০ জন জেলে থাকে। ১ জন সারেং থাকেন। তার নির্দেশনায় সাগরে চলতে হয়। সাগরে যাওয়র জন্য প্রতিটি ফিসিং বোটে ১০-১৫ দিনের খাবার সামগ্রী,তৈল ও প্রয়োজনীয় বরফ ভর্তি করে সাগরে ইলিশ মাছ ধরার জন্য যায়। তিনদিন একটানা সাগরে দিকে ফিসিং বোট চালানোর পর অথৈই সাগরে গিয়ে তারা ইলিশ জাল ফেলে। সেখান থেকে তারা আবার ফিরে আসতে পারবে কিনা সেটা তারা জানেনা। তারা সাগরে রান্না বান্না করে খায়। যতদিন পর্যন্ত তাদের বোটে মাছ ভর্তি না হয় ততদিন পর্যন্ত তারা সাগরে থাকেন। তারা সাগরে ১ থেকে দেড় লক্ষ টাকার মালামাল নিয়ে যান। এভাবে তারা ১০-১৫ দিন সাগরে মাছ ধরেন। মাছ ভর্তি করে তারা চলে আসেন । প্রতি বোটে ৩ থেকে ৪ কাউন(প্রতি কাউন ২০ পন) মাছ থাকে। এই মাছ বিক্রি করেন আড়তদারের গদিঘরে। ৫ থেকে ৬ লক্ষ টাকার মাছ বিক্রি করলে খরচ বাদে তাদের ৩ থেকে ৪ লক্ষ টাকা থাকে। পরে এই টাকা সব ভাগিরা ভাগ করে নিয়ে যায়।

জনতা বাজার মেঘনা পাড়ে কথা হয় আকতার ,খলির,হারুন ও নুরুলইসলাম সারেং এর সাথে ,তারা বলেন আমরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাগরে মাছ ধরতে যায়। আবার ফিরে আসব কিনা তাও জানিনা। জীবন বাজি রেখে সাগরে মাছ ধরি। ঝড়,বন্যা,জলদস্যু সব উপেক্ষা করে পরিবারের ভরন পোষন জোগাড় করতে সাগরে মাছ ধরতে যাই। সেই মাছ আমরা দাদন নেওয়া আড়তদারের কাছে বিক্রি করি। যা পাই তা দিয়ে সংসার চালাই। আমরা গরীব মানুষ তাই বাধ্য হয়ে আড়তদারের কাছ থেকে দাদন নেই। সাগরে মাছ ধরতে একটি ফিসিং বোটে ২০-২৫ লক্ষ টাকার চালান লাগে। এত টাকা আমরা পাবো কোথায় ? বাড়ীতে ছেলে-মেয়েরা চিন্তায় থকেন। কখন মাছ ধরে বাড়ী ফিরে আসব।

উত্তর সাকুচিয়া ইউনিয়নের জনতা বাজার মৎস্য ঘাটে কথা হয় মৃত আলাউদ্দিন চৌকিদারের ১৩ বছরের শিশু মোঃ শাকিলের সাথে। শাকিল বলেন,স্যারগো ৬ বছর সময় বাবা (ঠাডা)বজ্রপাতে মারা যান। আংগো সংসারে আমি বড়। মা ও বোনদের খাওয়ানের মত আর কেউ নাই। কেন স্কুল ছেড়ে মেঘনায় ইলিশ ধরতে যায় প্রশ্ন করলে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে বলেন,স্যারগো আর আয়ের উপর ৪জনের সংসার চলে। আমিই সংসারে বড়। সংসারে আর ছোট ২টি বোন আছে। এক বোন এয়ার খান সরকারী প্রাথমিক স্কুলে লেখা পড়া করে। আই নদীতে মাছ না ধরলে মা, বোনকে খাওয়াবে কে ? এইভাবে অভাবের সংসার চলে মনপুরা হতদরিদ্র জেলে পরিবারের লোকজনের।

কেমন চলে জেলে পরিবার ঃ
দুঃখ ও কষ্টের মধ্যে দিয়ে চলে জেলে পরিবারের জীবন। নদীতে মাছ পড়লে সংসারটা একটু ভালোভাবে চলে। ছেলে সন্তান নিয়ে পরিবারের লোকজন একটু স্বঃত্বিতে থাকেন। মাছ না পড়লে খুব কষ্টের মধ্যে থাকেন ছেলে সন্তান নিয়ে জেলে পরিবার। অনেক সময় উপোস থাকতে হয়। দায় দেনা পরিশোধের জন্য চিন্তা করতে হয় পরিবারকে।

কথা হয় হাজির হাট ইউনিয়নের চরযতিন গ্রামের ২নং ওয়ার্ডের জেলে আব্বাছের স্ত্রী ইয়াছনুর বেগমের সাথে। রাস্তার পাশেই অন্যের পুকুরপাড়ে একটি ছোট চনের ঘর উঠিয়ে কোন মতে ছেলে সন্তান শ্বশুর শাশুড়ীর নিয়ে বসবাস করছেন। পাশে বসে আছেন পাশের বাড়ীর তাসলিমা বেগমসহ ছোট ছোট শিশুরা । জিঙ্গেস করলাম কেমন আছেন ? বললেন কেমন আর থাকমু। নদীতে তেমন মাছ নেই । পোলানগুলো নিয়ে খুব কষ্টের মধ্যে আছি। আর স্মামী নদীতে মাছ ধরতে গেছে। ম্ছা পেলে হেই মাছ বিক্রি করে আংগোর জন্য দুপুরের চাল ডাল আনবেন। তারপর রান্না করমু। না আনলে উয়াস থাকমু। স্যারগো আমরা খুব কষ্টের মধ্যে আছি। আংগো কষ্ট কেউ বুঝেনা। দেনা করতে করতে সবই হারাইছি। দেনাদারেরা প্রতিদিন বাড়ীতে আইয়ে। মাছ না পাইলে আমরাা দিমু কিভাবে।

ইলিশ মাছের দর ঃ
হাজির হাট ঘাটের আড়তদার নিজামউদ্দিন হাওলাদার ও রামনেওয়াজ ঘাটের আড়তদার মোঃ মোশারেফ হোসেন জানান,মেঘনায় তেমন একটা মাছ পাওয়া যাচ্ছেনা। ভরা মৌসুমেও তেমন একটা মাছের দেখা মিলছেনা। আমরা খুব দুঃচিন্তার মধ্যে অছি। জেলেরাও তেমনএকটা ভালো নেই। আমরা জেলেদের লক্ষ লক্ষ টাকা দাদন দিয়েছি। নদীতে মাছ না থাকার কারনে জেলেদের পাশাপাশি আমরাও তেমন একটা ভালো অবস্থানে নেই।

সরজমিনে জনতা বাজার,হাজির হাট ও রামনেওয়াজ মৎস্য আড়তে গিয়ে দেখা যায়, এসব মৎস্য ঘাটে প্রতি ১ হালি(৪টা) প্রতিটির ওজন ১ কেজি থেকে ১ কেজি ২শত গ্রাম হলে আড়তে বিক্রি হয় ৩ হাজার থেকে ৪ হাজার টাকা, প্রতিটির ওজন ৮শ গ্রাম থেকে ৯শ গ্রাম হলে প্রতি হালি(৪টা)বিক্রি হয় ২ হাজার থেকে ৩ হাজার টাকা , এবং প্রতিটির ওজন ৫শ থেকে ৬শ গ্রাম হলে প্রতি হালি (৪টা) বিক্রি হয় ১ হাজার ৫শত থেকে ২ হাজার টাকার মধ্যে।

এসব আড়তদার মাছ ক্রয় করে ঢাকার আড়তে বিক্রি করেন। এসব আড়তদারেরা ঢাকার আড়ত দারের কাছ থেকে মোটা অংকের দাদন নিয়ে থাকেন। ঢাকার আড়তদারেরাও একটি নিদিষ্ট হারে কমিশন পেয়ে থাকেন।

কিভাবে ইলিশ ঢাকায় যায় ঃ
প্রতিদিন জেলেরা উপজেলার বিভিন্ন মৎস্য আড়তে মেঘনা থেকে ধরে আনা ইলিশ আড়তদারের কাছে বিক্রি করেন। আড়তদারেরা প্রতিদিন ইলিশ মাছ ঝুড়ি করে ঝুড়ির মধ্যে বরফ দিয়ে প্যাকেট করে রামনেওয়াজ ঘাট দিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে ঢাকার লঞ্চে উঠানো হয়। পরে ঢাকার বিভিন্ন আড়ত কাওরান বাজার,ঢাকার লঞ্চঘাট,যাত্রাবাড়ী,চাদপুরসহ বিভিন্ন আড়তে ইলিশ মাছ বিক্রি হয়।

মেঘনায় নদীতে মাছ না পড়লে জেলেরা খুব কষ্টের মধ্যে থাকেন। পরিবারের ভরন পোষন জোগার করতে হিমশিম ক্ষেতে হয় । জেলেদের নেই কোন নিজস্ব জায়গা বা ফসলি জমি। তারা শুধু মেঘনায় ইলিশ শিকারের উপর নির্ভশীল। মৎস্য মৌসুম ছাড়া বাকি সময় জেলেরা অন্য পেশায় জড়িয়ে পড়ে।

বাংলাদেশ সময়: ১৮:২২:০৬   ৭০১ বার পঠিত  |




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

প্রধান সংবাদ’র আরও খবর


তজুমদ্দিনে আগুনে পুড়ে ১৩ দোকান ছাই পাঁচ কোটি টাকা ক্ষতি ॥
এসএসসির ফল প্রকাশের সম্ভাব্য তারিখ ঘোষণা
এ কে ফজলুল হককে কেন ‘শেরে বাংলা’ বলা হয়?
জাতীয় পর্যায়ের লোকনৃত্য প্রতিযোগীতায় ভোলার মেয়ে স্বস্তিকার ২য় স্থান অর্জন
ভোলায় ইসতিসকার নামাজ আদায়
চরফ্যাসনে হিটস্ট্রোকে যুবকের মৃত্যু
ভোলায় তীব্র প্রবাহে অস্থির জনজীবন
গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য কাচারি ঘর বিলুপ্তির পথে ॥
ভোলা সদর উপজেলা নির্বাচন ২০২৪আপনাদের পবিত্র ভোট ৫ বছরের জন্য ভাল পাত্রে জমা রাখবেন-মোহাম্মদ ইউনুছ
দেশ ভাঙার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত কংগ্রেস: নরেন্দ্র মোদি

আর্কাইভ