প্রযুক্তির ফাঁদ ভয়ঙ্কর

প্রথম পাতা » প্রধান সংবাদ » প্রযুক্তির ফাঁদ ভয়ঙ্কর
মঙ্গলবার, ৯ মে ২০২৩



ভোলাবাণী ডেক্স।। সাইবার জগতে অপরাধ বাড়ছে আশঙ্কাজনক হারে। অপরাধের ধরনও পাল্টাচ্ছে প্রতিনিয়ত। এসব অপরাধের সবচেয়ে বেশি শিকার হচ্ছেন মধ্যবয়সি নারী, পুরুষ ও শিশুরা। বর্তমান পরিস্থিতিতে সাইবার নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের।

তারা বলছেন, অনেকেই প্রযুক্তি ব্যবহার সম্পর্কে ভালো জানেন না। আবার অনেকে জেনে-বুঝে সাইবার অপরাধে জড়াচ্ছেন। এ কারণে অনেকে এ অপরাধের শিকার হচ্ছেন। দেশে সাইবার অপরাধ নিয়ে কাজ করছেন এমন কর্মকর্তারা বলছেন, দেশে সাইবার অপরাধ বাড়ছে। প্রযুক্তি ব্যবহারে সবাইকে সতর্ক না হলে অপরাধ প্রবণতা আরও বাড়তে পারে বলে মনে করছেন তারা।

প্রযুক্তির ফাঁদ ভয়ঙ্কর

পুলিশের তথ্য বলছে, ২০২১ সালে পুলিশ সদর দফতরের সাইবার সাপোর্ট ফর ওমেন (পিসিএসডব্লিউ) উইংয়ে ১২ হাজারের বেশি অভিযোগ এসেছে। ২০২২ সালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে ২০ হাজারের বেশি নারী হয়রানির শিকার হয়েছেন।গত কয়েক বছরের তুলনায় চলতি বছর নারীদের তুলনায় পুরুষরা সাইবার অপরাধের শিকার হয়েছেন বেশি। তবে বছর শেষ না হওয়ায় এ ধরনের অপরাধের সঠিক পরিসংখ্যান নির্দিষ্ট করে জানায়নি সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো।

পুলিশ সূত্র বলছে, দেশের সব থানায় সাইবারসংক্রান্ত অপরাধের বিষয়ে বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ আসছে এবং এসব বিষয় নিয়ে মামলাও হচ্ছে। এসব মামলার দ্রুত তদন্ত করতে প্রতিটি থানায় পর্যায়ক্রমে সাইবার বিভাগ চালু করা হলেও যথাযথ সেবা পাচ্ছেন না ভুক্তভোগীরা। এ জন্য নতুন করে সারা দেশে সাইবার নিরাপত্তার জন্য কাজ করছে পুলিশের বিশেষ শাখা।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের হাতে আসা ৪০৬টি মামলার মধ্যে অনলাইন প্রতারণার মামলা ৯৮টি। এরপর রয়েছে ফেসবুকসহ বিভিন্ন মাধ্যম নিয়ন্ত্রণে নিয়ে (হ্যাক করে) অনলাইনে হয়রানির ঘটনা ৯৭টি।

এছাড়া অনলাইনে মানহানিকর বক্তব্য ও মিথ্যা তথ্য প্রচারের অভিযোগে ৭৮টি। ব্যাংক-মুঠোফোনে আর্থিক সেবায় প্রতারণার ৭২টি। এছাড়া অন্যান্য সাইবার অপরাধের অভিযোগে ৬১টি।
মামলার এজাহার সূত্রে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণে যেসব অপরাধের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে তার মধ্যে রয়েছে, অনলাইনে ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ডের ওটিপি জেনে নিয়ন্ত্রণ নিয়ে টাকা তুলে নেয়া, ব্যবহারকারীর অজান্তে ফেসবুকসহ বিভিন্ন অনলাইন মাধ্যম নিয়ন্ত্রণে নিয়ে প্রতারণা, লোভনীয় বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে ঋণ দেয়ার ফাঁদ, দামি রেস্তোরাঁয় খাবারের ভুয়া ফরমায়েশ দেয়া, কুইজের ফাঁদে ফেলে টাকা হাতিয়ে নেয়া, বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র সরবরাহ, অনলাইনে জাল নোটের ব্যবসাসহ নানা কায়দায় মানুষের কাছ থেকে অর্থ বের করে নেয়া হচ্ছে।

পুলিশের সাইবার অপরাধ বিভাগের একটি মামলার বিবরণ তুলে ধরে মামলার তদন্তকারী এক কর্মকর্তা বলেন, এক নারী (অপরাধী) প্রায়ই ভিকটিমের সঙ্গে একে অপরের নিজেদের বেশকিছু ব্যক্তিগত ছবি, ভিডিও শেয়ার করতেন। একপর্যায়ে তারা দুজন প্রাইভেট ভিডিও চ্যাটে যুক্ত হন। পরে ওই নারী ওই পুরুষের কাছে বেশ মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করেন। ওই পুরুষ বেশকিছু টাকা দিয়েও দেন।

ওই কর্মকর্তা বলেন, এখানেই শেষ নয়, একপর্যায়ে কৌশলে ওই নারী ওই পুরুষের পরিবার ও ব্যক্তিগত কয়েকজনের মোবাইল নম্বর নেন। ২-৩ মাস পরে আবারও ওই নারী তাকে ব্ল্যাকমেইল করতে শুরু করেন এবং মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করেন। এরপর সেই পুরুষ পুলিশের সাইবার ইউনিটে এসে একটি অভিযোগ করেন। সেই অনুযায়ী সাইবার ইউনিট এ ঘটনার তদন্ত করে ওই নারীকে আটক করে।

সাইবার ইউনিটের বেশ কয়েকটি মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যেসব পুরুষ সাইবার অপরাধের শিকার হয় এদের বেশিরভাগই মোটামুটি ধনী, বিবাহিত ও মধ্যবয়সি। কর্মকর্তারা বলছেন, যেসব মেয়ে সাইবার অপরাধের সঙ্গে যুক্ত তারা অধিকাংশ স্বামী-সংসারবিহীন এবং তাদের চলাফেরা এলোমেলো। অনেকে আবার ইয়াবা, আইস বা অন্যান্য মাদকের সঙ্গেও যুক্ত।

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সূত্রমতে, তাদের সাইবার সাপোর্ট সেন্টারের ফেসবুক পেজে প্রতিদিন গড়ে ১৫০টির মতো মেসেজ আসে। যার মধ্যে নারী-পুরুষদের নানাভাবে হয়রানি ও বিভিন্ন প্রতারণার অভিযোগই বেশি। ২০২২ সালে সাইবার সাপোর্ট সেন্টারের ফেসবুক পেজে ২৫ হাজার ৪৩৫টি অভিযোগ পেয়েছে। এর মধ্যে ১৬ হাজার ৩২৮টি অভিযোগের সমাধান করেছে সিআইডি।

কোনো ক্ষেত্রে অভিযুক্তকে ডেকে এনে আলোচনার মাধ্যমে, আবার ক্ষেত্রবিশেষে মামলা দিয়ে এসব অভিযোগের সমাধান করা হয়েছে। পাশাপাশি গত বছর সিআইডির সাইবার সাপোর্ট সেন্টার ফোনে অভিযোগ পেয়েছে ৯ হাজার ৭৭টি। ফোনে পাওয়া অভিযোগের মধ্যে ৬ হাজার ৮৫৯টি অভিযোগ সমাধান করে তারা।

চলতি বছরের জানুয়ারিতে ৪৭৭টি এবং ফেব্রুয়ারিতে ৫২৬টি অভিযোগ পায় সিআইডি। এ সবেরও পর্যায়ক্রমে অনুসন্ধান ও তদন্ত শেষে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।

সাইবার ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড রিস্ক ম্যানেজমেন্ট বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার (এসএসপি) মোহাম্মদ রেজাউল মাসুদ বলেন, সাইবার অপরাধের ধরন দিন দিন পাল্টাচ্ছে। প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় সাইবার অপরাধীরাও নিত্য নতুন কৌশল অবলম্বন করছে। এজন্য সিআইডির সক্ষমতা বাড়ানো উচিত।

তিনি বলেন, সাইবার অপরাধ বন্ধ বা প্রতিরোধ করা খুবই কঠিন কাজ। নিত্যনতুন পন্থা অবলম্বন করে প্রতারণা বা বুলিং করে সাইবার অপরাধীরা। কারণ, ফেসবুক ও অনলাইনে হাজারো ছবি ও ভিডিও পাওয়া যায় এখন। এজন্য সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবকে শক্তিশালী করার কাজ চলমান রয়েছে।

মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ ও পুলিশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. ওমর ফারুক  বলেন, দেশে যত সাইবার অপরাধ হয়, তার সব অভিযোগ পুলিশের কাছে আসেও না। বিচিত্র ধরনের সাইবার অপরাধের শিকার হচ্ছেন নানা শ্রেণিপেশার মানুষ। সামাজিক হেনস্তার ভয়ে অনেক ভুক্তভোগীই অভিযোগ দায়ের না করে চেপে যান।

এতে সাইবার অপরাধীরা আরও অপরাধের সুযোগ পায়। অপরাধ মোকাবিলার সঙ্গে যুগোপযোগী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। একই সঙ্গে প্রয়োজন সাধারণ মানুষকে সচেতন করা। সাইবার অপরাধের প্রাথমিক বিষয় নিয়ে মানুষের মাঝে সচেতনতামূলক কাউন্সেলিং করতে পারলে এসব অপরাধ অনেকটা নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।

এ ছাড়া স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে বাধ্যতামূলকভাবে সাইবার সুরক্ষাবিষয়ক সচেতনতামূলক বিষয় অন্তর্ভুক্ত করার পরামর্শ দেন তিনি। সাইবার অপরাধের ঘটনায় ভুক্তভোগীদের পর্যাপ্ত আইনি সহায়তা দিতে সরকারি উদ্যোগ দরকার বলেও মনে করেন এ অপরাধ বিশেষজ্ঞ।

ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইমের (উত্তর বিভাগ) উপকমিশনার মোহাম্মদ তারেক বিন রশিদ বলেন, সাইবার অপরাধের নতুন নতুন ধরন সামনে আসছে। বিভিন্ন অনলাইন মাধ্যম ব্যবহার করে প্রতারণার ঘটনাই বেশি ঘটছে। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে ব্ল্যাকমেইলিং, চাঁদাবাজি, অর্থ আত্মসাৎ, প্রশ্নফাঁস থেকে শুরু করে যৌন হয়রানির মতো ঘটনা ঘটছে।

তিনি বলেন, কেউ সাইবার অপরাধের শিকার হলে তাৎক্ষণিক পুলিশের সাহায্য নিতে হবে। সাইবার অপরাধের শিকার হলে বিষয়টি নজরে আসা মাত্রই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অবগত করতে হবে। প্রয়োজনে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করতে হবে। অথবা বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনেও (বিটিআরসি) লিখিতভাবে জানিয়ে রাখতে হবে। এতে করে কেউ মিথ্যাভাবে ফাঁসানোর চেষ্টা করলে অনেকটা সুরক্ষা পওয়া যাবে।

সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে সংঘটিত অপরাধের জন্য চলতি বছরের এপ্রিল মাস পর্যন্ত প্রায় ৭৫০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এসব অপরাধের বেশিরভাগই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ই-কমার্স ও এফ-কমার্সের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। তবে উন্নত প্রযুক্তির ওপর নির্ভর করে অপরাধগুলো এখন আরও বড় আকারে সংঘটিত হচ্ছে। হ্যাকিং, কপিরাইট লঙ্ঘন, শিশু পর্নোগ্রাফির মতো অপরাধগুলো বর্তমানে উচ্চমাত্রায় বেড়ে চলেছে। এ জন্য ব্যক্তিগতভাবে সবাইকে সচেতন হতে হবে। না হলে সাইবার অপরাধের শিকার হয়ে মানুষ নিরাপত্তা ও আর্থিক দিক দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

বাংলাদেশ সময়: ১২:৫৪:৫৯   ৯১ বার পঠিত  |




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

প্রধান সংবাদ’র আরও খবর


ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাল ইসরায়েল
৩ মাস ধরে বন্ধ বিদ্যুৎ প্লান্টতীব্র গরম আর বিদ্যুতের ভয়াবহ লোডশেডিংয়ে অতিষ্ঠ ভোলাবাসী
মনপুরায় প্রাণিসম্পদ প্রদর্শনী মেলার উদ্ভোধন ॥
চরফ্যাশনে স্বামীর প্রহার থেকে স্ত্রীকে রক্ষা করতে গিয়ে আহত-৩
চরফ্যাশনে সাংবাদিক পরিচয়ে চাঁদাবাজীতে অতিষ্ঠ মানুষ
চরফ্যাসনে তুচ্ছ ঘটনায় প্রতিপক্ষের হামলায় আহত ৯
ইসরায়েলকে ‘সহায়তা করা’ নিয়ে মুখ খুলল সৌদি
প্রিয়জনদের সঙ্গে ঈদ উদযাপন শেষেকর্মস্থলে ফিরছে মানুষ, ইলিশা ঘাটে যাত্রীদের চাপ
আইপিএলে চতুর্থ দ্রুততম সেঞ্চুরিয়ান ট্রাভিস হেড
উত্তর দিঘলদী ইউনিয়নে জনসভা ও পথসভা করেছেন চেয়ারম্যান প্রার্থী মোহাম্মদ ইউনুছ

আর্কাইভ