লাইলাতুল কদর

প্রথম পাতা » ইসলাম ও ধর্ম » লাইলাতুল কদর
শনিবার, ৮ মে ২০২১



মো. জাবের আল আব্দুল্লাহ।।

আভিধানিক দিক থেকে এর দুটি অর্থ হয় =

১/মহত্ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব।

অর্থাৎ : লাইলাতুল কদর এমন একটি রাত যা অন্যান্য রাতের চাইতে অধিক পরিমাণে শ্রেষ্ঠ ও মার্যাদা পূর্ণ।

যেমন আল্লাহর বানীঃ

إِنَّا أَنزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةٍ مُّبَارَكَةٍ إِنَّا كُنَّا مُنذِرِينَ

আমি একে নাযিল করেছি। এক বরকতময় রাতে, নিশ্চয় আমি সতর্ককারী। (সুরা দুখান)

এই রাত্রিটা শ্রেষ্ট হওয়ার ব্যাপারে একটা প্রমাণই আমাদের জন্য যথেষ্ট আর তা হল পবিত্র কুরআন মাজিদ।

মানবজাতির জন্য কুরআনের চেয়ে বড় নেয়ামত আর কি হতে পারে!!

এই কুরআনের জন্যই এই রাতটির এত মহত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা করা হয়েছে।

 

২/নির্ধারণ করা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা।

অর্থাৎ :লাইলাতুল কদর এমন একটি রাত্র যে রাতে আল্লাহ তায়ালা সবকিছুর ভাগ্যলিপি নির্ধারণ করেন এবং বস্তুর সঠিক পরিমাণ নির্ধারণ করেন।

কুরআনের ভাষায়ঃ

فِيهَا يُفْرَقُ كُلُّ أَمْرٍ حَكِيمٍ

এ রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় স্থিরীকৃত হয়। (সুরা দুখান ৪)

দুনিয়াতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আসমানি কল্যাণকর কাজগুলো আল্লাহ তায়ালা ফেরেশতাদের দ্বারা সম্পাদন করে থাকেন।

রব্বে কারিম বলেনঃ

تَنَزَّلُ الْمَلَائِكَةُ وَالرُّوحُ فِيهَا بِإِذْنِ رَبِّهِم مِّن كُلِّ أَمْرٍ

এতে প্রত্যেক কাজের জন্যে ফেরেশতাগণ ও রূহ অবতীর্ণ হয় তাদের পালনকর্তার নির্দেশক্রমে। (কদরঃ ৪)

 

লাইলাতুল কদর নির্ধারণঃ

——————————

২৭ তারিখে লাইলাতুল কদর একেবারে সুনির্দিষ্ট- এমন কোনো তথ্য-প্রমাণ নেই। তবে বহুসংখ্যক প্রমাণ রয়েছে যে, ২৭ তারিখে লাইলাতুল কদর হওয়ার সম্ভাবনা সর্বাধিক। একে শুধু সম্ভাবনা হিসেবে গ্রহণ করা যায়, সুনিশ্চিত হিসেবে নয়।

 সহিহ বোখারি ও সহিহ মুসলিমের একাধিক হাদিসে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তোমরা শেষ সাতে লাইলাতুল কদর অনুসন্ধান কর।

লাইলাতুল কদর কত তারিখ এ বিষয়ে ৪০টির অধিক মত রয়েছে। তবে কোরআন ও হাদিসের আলোকে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মত হলো রমজানের শেষ দশকের বেজোড় রাতের যে কোনো এক রাতে অর্থাৎ ২১, ২৩, ২৫, ২৭ বা ২৯তম রাতে।

 

হাদিসে এসেছেঃ

عَنْ عَائِشَةَ، قَالَتْ كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يُجَاوِرُ فِي الْعَشْرِ الأَوَاخِرِ مِنْ رَمَضَانَ، وَيَقُولُ ‏ “‏ تَحَرَّوْا لَيْلَةَ الْقَدْرِ فِي الْعَشْرِ الأَوَاخِرِ مِنْ رَمَضَانَ ‏”‏‏.‏

 

‘আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ:

 

তিনি বলেন, আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রমযানের শেষ দশকে ইতিকাফ করতেন এবং বলতেনঃ তোমরা রমযানের শেষ দশকে লাইলাতুল কদর অনুসন্ধান কর।(মিশকাতুল মাসাবিহ)

 

লাইলাতুল কদরের মার্যাদা ও ফজিলতঃ

——————————————–

এই রাতের ফজিলত বর্ণনা করতে গিয়ে আল্লাহ রব্বুল আলামিন একটা সুরাই নাজিল করেছেনঃ

যা সুরা কদর নামেই পরিচিত,

একদিন রাসূলুল্লাহ (সা.) বনি ইসরাইলের ৪ জন আবেদের কথা বলেন, যারা ৮০ বছর পর্যন্ত নিরলসভাবে আল্লাহ পাকের ইবাদতে রত ছিলেন। ওই সময়ে এক মুহূর্তের জন্যও আল্লাহ পাকের হুকুমের বরখেলাপ করেননি। উক্ত ৪ জন আবেদ হলেন, হযরত আইয়ুব (আ.), হযরত জাকারিয়া (আ.), হযরত হিজকীল (আ.) এবং হযরত ইউশা বিন নুন (আ.)।

রাসূলুল্লাহর (সা.) কাছে একথা শুনে সাহাবায়ে কেরাম খুবই আশ্চর্যান্বিত ও বিচলিত হলেন যে তাদের পক্ষে এতো ইবাদত করা সম্ভব নয়। কারণ আখেরী নবীর উম্মত ৬০-৭০ বছরের মধ্যে ইন্তেকাল করেন। কাজেই তাদের সমান বয়স না পাওয়ায় এতো ইবাদত করা সম্ভব নয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ পাক সূরা কদর নাজিল করে সাহাবায়ে কেরামকে সান্তনার বাণী শুনিয়ে ছিলেন।

  إِنَّا أَنزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةِ الْقَدْرِ

আমি একে নাযিল করেছি শবে-কদরে।

  وَمَا أَدْرَاكَ مَا لَيْلَةُ الْقَدْرِ

শবে-কদর সমন্ধে আপনি কি জানেন?

  لَيْلَةُ الْقَدْرِ خَيْرٌ مِّنْ أَلْفِ شَهْرٍ

শবে-কদর হল এক হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।

  تَنَزَّلُ الْمَلَائِكَةُ وَالرُّوحُ فِيهَا بِإِذْنِ رَبِّهِم مِّن كُلِّ أَمْرٍ

এতে প্রত্যেক কাজের জন্যে ফেরেশতাগণ ও রূহ অবতীর্ণ হয় তাদের পালনকর্তার নির্দেশক্রমে।

  سَلَامٌ هِيَ حَتَّى مَطْلَعِ الْفَجْرِ

এটা নিরাপত্তা, যা ফজরের উদয় পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।

 

শবে কদর সম্পর্কে গবেষণা করলে এর কয়েকটি ফজিলত উল্লেখ করা যায়।

নিম্নে সংক্ষেপে এর কয়েকটি উল্লেখ করা হল,

 

১/ শবে কদরের ইবাদত এক হাজার মাসের ইবাদতের চেয়েও বেশি বরকতময় ও শ্রেষ্ঠ’’, ২/ শবে কদরের রাতেই প্রথম কুরআন নাজিল হয়।

৩/ শবে কদরের রাতে হযরত জিব্রাইল (আ.) অগনিত ফেরেস্তা নিয়ে ধরাপৃষ্ঠে অবতরণ করে বিশ্ববাসীর জন্য অসংখ্য কল্যাণ ও প্রাচুর্য বিতরণ করেন।

৪/ শবে কদরের রাতে আল্লাহর মাহবুব বন্দারা অবর্ণনীয় আন্তরিক শান্তি অনুভব করেন।

৫/ শবে কদরের রাতে অবিরাম ধারায় আল্লাহ তায়ালার রহমত ও বরকত বিশ্ববাসী ও মুমিনদের অন্তরে নেমে আসে। আল্লাহ পাক অসংখ্য পাপীকে ক্ষমা করে থাকেন। তওবা কবুল হয়। আসমানের সমস্ত দ্বার খুলে দেওয়া হয়।

৬/ এ রাতে গরম ও শীত কোনোটি বেশি অনুভূত হয় না। ফজর পর্যন্ত নক্ষত্র অটুট থাকে। সূর্য উদয়কালে প্রখরতা থাকেনা ও সূর্য উদয়কালে শয়তান উপস্থিত থাকে না।

 

এছাড়াও হাদিস শরিফে এসেছে,

 

 عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ‏ “‏ مَنْ يَقُمْ لَيْلَةَ الْقَدْرِ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ ‏”‏‏.‏

 

আবূ হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ:

তিনি বলেন, আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এরশাদ করেনঃ যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে নেকির আশায় কদরের রাতে ইবাদতের মধ্যে রাত্রি জাগবে, তার পূর্বের গুনাহ্‌ ক্ষমা করে দেয়া হবে।

(সহিহ বুখারী ও মুসলিম)

 

লাইলাতুল কদরেও কিছু লোক ক্ষমা পবেনাঃ

————————————–

শবে কদর মুসলমানদে জন্য একটি বিরাট পাওয়া।

এই রাত্রে ইবাদাত করে একজন মুসলমান তার স্রষ্টার একেবারেই নিকটস্থ হয়ে যায়।

এই রাত্রে ইবাদাতকারি কে জান্নাত ডাকতে থাকে। একজন মুমিন সফল হওয়ার পিছনে শবে কদরের গুরুত্ব অপরিসীম।

কিন্তু এই রাত্রিতেও আল্লাহর এমন কিছু কপাল পোরা বান্দা ইবাদাত করবে কিন্তু তার কোন নেক আমল কবুল হবেনা।

এবং সে মাফও পাবেনা,

 

এক- মদপানে অভ্যস্ত ব্যক্তি,

 

দুই- মাতাপিতার অবাধ্য সন্তান,

 

তিন- আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী,

 

চার- হিংসা বিদ্বেষ পোষণকারী,

 

শবে কদরে এই চার শ্রেণির মানুষকে ক্ষমা করা হবে না, তাদের কোনো কিছুই আল্লাহর দরবারে কবুল হবে না যতক্ষণ না তারা এসব অপকর্ম থেকে সংশোধন হবে।

 

লাইলাতুল কদরে আমাদের করণীয়ঃ

ফরয নামায সমূহ ঠিক সময়ে জামাআ’তের সাথে আদায় করা :

 

যেমন মাগরিব, ইশা এবং ফজরের নামায। তার সাথে সাথে সুন্নতে মুআক্কাদা, তাহিয়্যাতুল মসজিদ সহ অন্যান্য মাসনূন নামায আদায় করা।

 

১/নফল নামায আদায় করাঃ

—————————

যেহেতু এই রাতের মার্যাদা অন্যান্য রাতের চায়তে অনেক বেশি, তাই এই রাতের ইবাদাত সমূহের মার্যাদাও তুলনামূলক বেশি। তাই আমাদের উচিত এই রাতে বেশি বেশি নফল নামায আদায় করা।

 

২/কুরআন শরীফ তিলাওয়াত করা:-কারণ নফল ইবাদতের মাঝে পবিত্র কুরআন তিলাওয়াতই হলো বড় ইবাদাত।

আমরা যতটুকু সম্ভব তারতিল ও তাজবিদ সহকারে কুরআন তিলওয়াত করবো কেননা কুরআন তিলাওয়াত দ্বারা মানুষের অন্তরের কালিমা দূরীভুত হয়।

এমনিতেই যদি আমরা কুরআন তিলওয়াত করি একটি হরফে দশটি নেকি পাই,

হাদিসে এসেছে,

 রাসূল (স.) এরশাদ করেন-‘যে ব্যক্তি পবিত্র কুরআনের একটি হরফ পাঠ করবে তার জন্য একটি হাসানাহ বা পূণ্য নির্ধারণ করা হবে। আর এই একটি হাসানাহ (নেকি) দশ নেকির সমান। আমি বলি না আলিফ-লাম-মীম একটি হরফ, বরং আলিফ একটি হরফ, লাম একটি হরফ, মীম একটি হরফ।’ অর্থাৎ-‘আলিফ লাম মীম’ পাঠ করলে তিন দশে ত্রিশ নেকি পাওয়া যায়।

 সুতরাং মর্যাদাশীল লাইলাতুল কদরে পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত আমাদের জন্য আরো বেশি উপকারী।

 ---

৩/কবর জিয়ারত করা : পবিত্র লাইলাতুল কদরে মুর্দাগণের কবর জিয়ারত করা এবং তাদের জন্য মাগফিরাত ও দরজা বুলন্দি কামনা করা জীবিত ওয়ারিছদের উপর নৈতিক দায়িত্ব। এ দায়িত্ব সব সময় পালন করা প্রয়োজন। তবে লাইলাতুল কদরের গুরুত্বের কারণে এ রাতে জিয়ারতের উপকারিতা অনেকগুণ বেশি।

 

৪/ আল্লাহর রাস্তায় কিছু দান-সাদকা করা :

 

নবী (সাঃ) বলেনঃ

এই রাত্রিতে যত বেশি দান সাদকা করা যায় ততই উত্তম। কেননা এই মহিমান্বিত রাত্রে সাদকা করে আপনি অঢেল সাওয়াবের অধিকারী হতে পারেন।

 

পরিশেষেঃ-

শবে কদরের একটি রাতে এই রকম ইবাদতের মাধ্যমে আপনি ৮৩ বছর ৪ মাসের সমান সওয়াব অর্জন করতে পারেন। ইবাদতের এই সুবর্ণ সুযোগ যেন হাত ছাড়া না হয়। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দিন…।

আমিন

 

বাংলাদেশ সময়: ৪:৩৭:৫৭   ১২৯ বার পঠিত  |




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

ইসলাম ও ধর্ম’র আরও খবর


নারীরা যেভাবে ইতেকাফ করবেন
পবিত্র মাহে রমজানের ৮ সুন্নত
আল্লাহর যেসব হক আদায় করা মুমিনের কর্তব্য
তুরাগতীরে দেশের বৃহত্তম জুমার জামাত অনুষ্ঠিত
আতিথেয়তায় আল্লাহর অনুগ্রহ মিলে যেভাবে
লিবিয়ায় মুসলিম বিজয়ের ইতিহাস
আজ ইসলামী চিন্তাবিদ মাওলানা মোঃ হাবিবউল্লাহ’র ৩য় মৃত্যুবার্ষিকী
কাদের জন্য ওমরাহ , এর ফজিলত ও কবুল হওয়ার শর্ত
ধর্মীয় সম্প্রীতির নতুন ভুবন: আমিরাতে একই কমপ্লেক্সে মসজিদ-গির্জা-সিনাগগ
পবিত্র হজ আজ লাব্বাইক ধ্বনিতে মুখর হবে আরাফাতের ময়দান

আর্কাইভ