
পর্ব- ২
লেখক: ফজলুল কাদের মজনু - সভাপতি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, ভোলা জেলা শাখা।
৭. ইতিমধ্যে বিশ্ব কূটনৈতিক অঙ্গনে কয়েকটি অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। সমসাময়িক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিকসনের চীন সফরে চীন-মার্কিন কূটনৈতিক সম্পর্ক একটি নির্দিষ্ট রূপ ধারণ করে। প্রেসিডেন্ট নিকসন চীন সফরে চীনের সঙ্গে সরাসরি বাণিজ্য ব্যবস্থা এবং বিভিন্ন চুক্তির কথা ঘোষণা করেন। এ সময় চীনা প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছে একটি চিঠি প্রেরণ করেন। আর এই চিঠির সারমর্ম ছিল যে চীন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ভারতে নির্বাসিত তিব্বতের নেতা দালাই লামার সমকক্ষ হিসেবে গণ্য করেন। এছাড়াও এই চিঠিতে চীন উল্লেখ করে যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি ভারতের সমর্থনকে চীন, ভারত সম্প্রসারণ নীতি হিসেবে উল্লেখ করে। সেই সময়ের চীন-মার্কিন আতাত ভারতের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এক পর্যায়ে বাংলাদেশ এর স্বাধীনতা যুদ্ধকে কেন্দ্র করে বিশ্ব রাজনীতি অস্থির হয়ে উঠেছিল। এরই মধ্যে চীন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় নিজেদের সমর্থনের কথা জানান দিতে চীন ভারত মহাসাগরে আন্তমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা করার কথা ঘোষণা করে। এ ব্যাপারে ভারত সরকার উদ্বেগ প্রকাশ করে। ৯ জুন ১৯৭১ সালে ভারতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রী বাবু জাগজীবন রাম রাজ্যসভায় বলেন, চীন তিব্বতে এক লক্ষ চীনা সৈন্য মোতায়ন করেছে। পররাষ্ট্র দপ্তরের ডেপুটি মন্ত্রী যোগেন্দ্র পাল সিং বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ জনগণের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানের নির্মম সশস্ত্র আক্রমণের বিরুদ্ধে ভারতের অবস্থান, এর ফলে ভারতের প্রতি চীনের বৈরী মনোভাব কঠিন হয়ে উঠেছে।
৮. একটি সূত্র থেকে জানা যায় যে, বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী চীনা প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাইকে একটি চিঠি লিখেন। উক্ত চিঠিতে ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের জনসাধারণের ওপর পাকিস্তানের সশস্ত্র আক্রমণ প্রতিরোধে বেইজিং-এর নিষ্ক্রিয়তা সমর্থন করার জন্য চীনা প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। বাংলাদেশ প্রশ্নে ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী চীনা কর্তৃপক্ষকে বাংলাদেশ সমস্যার খুঁটিনাটি বিষয় সমূহ অবহিত করেন।
৯. এরই মধ্যে ৩ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে পাকিস্তান ভারতের উপর পুরোপুরি যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং ভারতের ওপর আক্রমণ শুরু করে। ৮ ডিসেম্বর ১৯৭১ চীনা সংবাদমাধ্যম পিপলস ডেইলি অত্যন্ত রূঢ় ভাষায় মন্তব্য করে যে “বাংলাদেশ একটা প্রহসন আর ভারত হচ্ছে এই প্রহসনের স্রষ্টা। এই প্রহসন তৈরির পরিণাম ভারতকে অবশ্যই বরণ করতে হবে।” এছাড়াও জাতিসংঘে চীনা প্রতিনিধির বক্তৃতায় এবং বিভিন্ন মন্তব্য থেকে বোঝা যায় যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে চীন কোন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে। চীনা কর্তৃপক্ষ বিশ্বাস করে যে, বাংলাদেশ ভারতীয় সেনাবাহিনীর সৃষ্টি।
১০.১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরন সিং জাপান সফরে যান এবং ভারত-চীনের মধ্যে বিরোধপূর্ণ সম্পর্কের উন্নতি সাধনের জন্য জাপানের মধ্যস্থতা আশা করেন। উক্ত সফরে চীন ভারতের সম্পর্কের বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে সরন সিং জানান যে চীন-ভারত সম্পর্কের উন্নতি কবে নাগাদ হতে পারে, তার নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব নয়। তবে তিনি বলেন, এই দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে যে উদাসীনতা এবং উত্তেজনা বিদ্যমান তা হয়তো বৈষয়িক উত্তেজনার হ্রাস পাওয়ার সাথে সাথে লোপ পাবে। তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশ পরিস্থিতি ও পাক-ভারত যুদ্ধের ফলে ভারত-চীন সম্পর্কের যে অন্তরায় সৃষ্টি হয়েছে, তা আর থাকবে না বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। ভারত-পাকিস্তান এর মধ্যে সম্পাদিত সিমলা চুক্তির ফলে ভারতীয় উপমহাদেশের বৈরী পরিস্থিতি অনেকটাই উন্নতির দিকে যাচ্ছিল। এই উপমহাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি ঘটায় চীন ভারতের সম্পর্কের উন্নতি হতে যাচ্ছিল।
১১. পাকিস্তানের সেনাবাহিনী, ১৯৭১ সালের বাংলাদেশ সৃষ্টিতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সহায়তার ও ভূমিকার বিরুদ্ধে বদলা নেওয়ার জন্য তাদের সমরাস্ত্র ব্যবস্থা উন্নয়নের লক্ষ্যে চীনের সহায়তা লাভ করে এবং চীনের এই প্রত্যক্ষ সহায়তার ফলে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের সমরাস্ত্র ব্যবস্থা ব্যাপক শক্তিশালী করে।
১২. এর সাথে চীন ভারতীয় ভূখণ্ডের উপর পূর্বের দাবি অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের সাথে নতুন যুদ্ধ কৌশলে একত্রিত হয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে ভারত সীমান্তের লাদাখ অঞ্চলে চীন ব্যাপক সৈন্য ও অস্ত্র মোতায়ন করেছে। ভারত এবং তার ভূখণ্ডে চীনা অনুপ্রবেশ রোধে প্রতিরক্ষামূলক প্রস্তুতি ধীরে ধীরে বাড়িয়ে চলেছে।
চলবে.…..…….
বাংলাদেশ সময়: ১৪:৫৪:৪৪ ৪০ বার পঠিত | চীন ভারতের মুখোমুখি অবস্থানপর্ব- ২বাংলাদেশের স্বাধীনতা