ভোলাবাণী ডেক্স।।
রাষ্ট্রপতির পদ থেকে মো. সাহাবুদ্দিনকে অপসারণ ইস্যুতে অবস্থান পাল্টাবে না বিএনপি। এ ইস্যুতে এরই মধ্যে সংবিধানের বাইরে না যাওয়ার যে দলীয় অবস্থান নিয়েছে, সেটাতেই বহাল রয়েছেন তারা। গত সোমবার রাতে অনুষ্ঠিত বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এটি নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে। সেখানে সাংবিধানিক শূন্যতা বা রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি হয়, এমন কোনো উদ্যোগ না নিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে দলটি।
বিএনপি বলছে, বিপ্লব বা অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলেও সাংবিধানিক পথেই অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে। সুতরাং সেই সংবিধানকে উপেক্ষা করে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যৌক্তিক হবে না। দলটি মনে করছে, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সংবিধানকে বাতিল ঘোষণা করা হলে দেশে সাংবিধানিক সংকট বা রাজনৈতিক সংকট তৈরি হবে। এমনটা হলে নির্বাচন আরও পিছিয়ে যেতে পারে বলে শঙ্কা তাদের। বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান। এরপর ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, বিগত সরকারের আমলে দলীয়করণের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। একটি অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টিতে রাষ্ট্রকাঠামোর প্রয়োজনীয় সংস্কারে দশটি কমিশন গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার। সংস্কার প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কয়েক দফা সংলাপও করে সরকার। এমন অবস্থায় শেখ হাসিনার পদত্যাগের দালিলিক প্রমাণ নেই বলে সম্প্রতি মন্তব্য করেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। রাষ্ট্রপতির এই বক্তব্যের প্রেক্ষাপটে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনসহ কয়েকটি সংগঠন তার পদত্যাগের দাবি তোলে। গত ২২ অক্টোবর বঙ্গভবন ঘেরাওয়ের কর্মসূচিও পালন করা হয়।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ২২ অক্টোবর রাতে দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে ভার্চুয়ালি বৈঠক করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। সেখানে নেতারা অভিমত দেন, অসাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ করা ঠিক হবে না। এমনটা হলে দেশে সাংবিধানিক সংকট তৈরি হবে। এতে করে নির্বাচন আরও দীর্ঘায়িত হবে। দলীয় এমন সিদ্ধান্তের আলোকে পরদিন ২৩ অক্টোবর বিএনপির তিন সদস্যের প্রতিনিধিদল যমুনায় গিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করে। সেখানে দলীয় অবস্থান তুলে ধরে বিএনপি নেতারা বলেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রপতির পদ নিয়ে এই মুহূর্তে দেশে সাংবিধানিক, রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক সংকট তৈরি হোক, সেটা কাম্য নয় বিএনপির। বিএনপি চায় না দেশে নতুন করে কোনো সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টি হোক। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক নিয়ে ওইদিন বিকেলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘রাষ্ট্রপতির পদ একটা সাংবিধানিক পদ বা একটা প্রতিষ্ঠান, সর্বোচ্চ সাংবিধানিক পদ। এই পদে হঠাৎ করে পদত্যাগের মাধ্যমে শূন্যতা সৃষ্টি হলে রাষ্ট্রীয় সংকট ও সাংবিধানিক শূন্যতা সৃষ্টি হবে। রাষ্ট্রীয় সংকট সৃষ্টির মাধ্যমে যদি গণতন্ত্রে উত্তরণের পথটা বিলম্বিত, বাধাগ্রস্ত কিংবা কণ্টকাকীর্ণ হয়, তা জাতির কাম্য নয়।’
এরপর ওইদিন (২৩ অক্টোবর) রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠক হয়। সেখানে রাষ্ট্রপতির অপসারণের মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে দলীয় অবস্থান পরিষ্কার করেন বিএনপি নেতারা। তারা বলেন, গণঅভ্যুত্থানে সরকার পরিবর্তনের পর দেশের সংবিধান স্থগিত করা হয়নি। রাষ্ট্রপতির কাছে শপথ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। ফলে এখন সংবিধানের বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
বিএনপির এমন অবস্থানে রাষ্ট্রপতি অপসারণ ইস্যুতে ছাত্রনেতাদের দাবি কিছুটা থমকে যায়। এরপর এ ইস্যুতে ঐক্য সৃষ্টির চেষ্টায় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক শুরু করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতারা। এর অংশ হিসেবে গত শনিবার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে তিন সদস্যের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠক করেন ছাত্রনেতারা। সেখানে ছাত্রনেতাদের তরফ থেকে বিএনপিকে তাদের অবস্থান জানানো হয়, কেন তারা রাষ্ট্রপতির অপসারণ চান, সেটিও তুলে ধরেন। তবে বিএনপি তাদের চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত জানায়নি। দলটি তখন জানায়, এ ইস্যুতে দলীয় ফোরামে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবেন তারা।
এর পরিপ্রেক্ষিতে গত সোমবার রাতে অনুষ্ঠিত বিএনপির স্থায়ী কমিটির সভায় প্রধান এজেন্ডা ছিল রাষ্ট্রপতির অপসারণ ইস্যু। জানা গেছে, সভার শুরুতে রাষ্ট্রপতি ইস্যুতে ছাত্রনেতাদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকের আলোচনা তুলে ধরেন মির্জা ফখরুল ইসলাম। এরপর নেতারা তাদের অভিমত ব্যক্ত করেন। তারা ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী রাষ্ট্রে নতুন করে কোনো ধরনের সংকট বা জটিলতায় পড়ুক—এমন পরিস্থিতি সতর্কভাবে এড়িয়ে চলার অবস্থান প্রকাশ করেন। বিশেষ করে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের পদত্যাগ প্রশ্নে।
সভায় কেউ কেউ বলেন, সম্প্রতি রাষ্ট্রপতির অপসারণ ও প্রক্লেমেশন অব সেকেন্ড রিপাবলিক (দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্রের ঘোষণাপত্র) ঘোষণাসহ কয়েকটি দাবি তোলা হয়েছে। এ জন্য যদি সংবিধান বাতিল করা হয়, তাহলে দেশে বড় ধরনের সংকট তৈরি হতে পারে। তারা যুক্তি তুলে ধরে বলেন, সাংবিধানিক সংকট এ জন্য সৃষ্টি হবে যে, রাষ্ট্রপতি কার কাছে পদত্যাগ করবেন, সে ধরনের কোনো অপশন খোলা নেই। প্রধান বিচারপতিও বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন বলে সভায় একজন জানান।
স্থায়ী কমিটির সভায় বিএনপি নেতারা বলেন, রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় সংস্কারে অন্তর্বর্তী সরকার এরই মধ্যে দশটি কমিশন গঠন করেছে। তারাই মতামত দেবে কী ধরনের সংস্কার হতে পারে রাষ্ট্রের। তাদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়া উচিত। বাইরে থেকে নানা ধরনের দাবি তুললে কমিশন ঠিকমতো কাজ করতে পারবে না।
সভায় এবার ৭ নভেম্বর ‘জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস’ জাঁকজমকভাবে পালন করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ উপলক্ষে ঢাকাসহ সারা দেশে জেলা ও মহানগরে ১০ দিনের কর্মসূচি থাকবে। ওইদিন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের (বীরউত্তম) মাজারে বড় ধরনের শোডাউন করবে দলটি। এ ছাড়া ঢাকায় বর্ণাঢ্য র্যালি ও আলোচনা সভা হবে।
লন্ডন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান স্থায়ী কমিটির সভায় সভাপতিত্ব করেন। সভায় মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ছাড়াও স্থায়ী কমিটির সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান কাজ হচ্ছে নির্বাচন আয়োজন। তাই দ্রুত নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা করা দরকার। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও দ্রব্যমূল্যের দিকে নজর দেওয়া। একই সঙ্গে দেশে সাংবিধানিক কোনো শূন্যতা যাতে সৃষ্টি না হয়, সেদিকেও খেয়াল রাখা উচিত।
বাংলাদেশ সময়: ৯:৪১:৫২ ৩২ বার পঠিত |