ভোলাবাণী ডেক্স।।
প্রায় দুই বছর ধরে ভোগ্যপণ্যের বাজারে বেসামাল পরিস্থিতি বিরাজ করছে। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম, আমদানিনির্ভরতা, বাজারে সিন্ডিকেট, মজুদদারির কারণে বেড়েই চলছে নিত্যপণ্যের দাম। এ ছাড়া বিগত সরকারের সময়ে বাজার নজরদারির ঘাটতি এবং অতিমুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কারণে নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি নিত্যপণ্যের বাজার। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত দুই মাসে মূল্যস্ফীতিতে কিছুটা নিম্নযাত্রা দেখা গেলেও জনসাধারণের স্বস্তির জায়গা এখনো অনেক দূর। বাজার বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত দুই মাসেও ভোগ্যপণ্যের গড় দাম বেড়েছে প্রায় ১৬ শতাংশ। বিশেষ করে ডিম, আটা, ডাল, পেঁয়াজের মতো নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে অনেকটা বেপরোয়াভাবে। এতে আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের হিসাব মেলাতে হিমশিম খাচ্ছেন সাধারণ মানুষ।
২০২৪-২৫ অর্থবছরের আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসের বাজার বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, দুই মাসের ব্যবধানের দেশের ভোগ্যপণ্যের গড় দাম বেড়েছে প্রায় ১৬ শতাংশ। কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দুই মাসে আটার দাম বেড়েছে ১১ শতাংশ, মসুর ডালে ১৫ দশমিক ৪০ শতাংশ ও ডিমের দাম বেড়েছে ২১ দশমিক ৩৪ শতাংশ। এ ছাড়া তেল, পেঁয়াজ ও চালের মতো পণ্য অপরিবর্তিত দামেই বিক্রি হচ্ছে। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে এসব ভোগ্যপণ্যের দাম ১০ থেকে সর্বোচ্চ ৩৩ শতাংশ বেড়েছে।
আওয়ামী সরকারের শেষ মাস জুলাইয়ে দেশে গড় মূল্যস্ফীতি হয় ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশ আর খাদ্য মূল্যস্ফীতি এক যুগে সর্বোচ্চ পর্যায়ে গিয়ে ১৪ শতাংশ ছাড়ায়। কিন্তু বাজারের চিত্র ভিন্ন থাকলেও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম দুই মাসে মূল্যস্ফীতি কমেছে বলে জানিয়েছে বিবিএস। সর্বশেষ সেপ্টেম্বরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমে ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ হয়েছে। যদিও খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের বেশি রয়েছে এখনো। এই নিম্নমুখী মূল্যস্ফীতির প্রবণতার মধ্যেও কিছু পণ্যের দাম বাড়ছে প্রতিযোগিতামূলকভাবে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমলেও বাস্তবতা ভিন্ন। বিশেষ কয়েকটি ভোগ্যপণ্য গুটিকয়েক কোম্পানিকে এলসি খোলার অনুমতি দিয়ে বাজারে অস্থিরতা তৈরি করা হচ্ছে। বিপরীতে সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে সরকারি সংস্থাগুলো এখনো আন্তরিকতা নিয়ে কাজ করছে না। তারা আন্তরিকভাবে কাজ করলে খুব দ্রুত বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
তবে দেশের বাজারে ভোগ্যপণ্যের দাম আরও বেশ কিছু সময় ঊর্ধ্বমুখী থাকবে বলে মনে করেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, দেশের দীর্ঘ সময় মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখীর প্রবণতায় ছিল। কিন্তু নতুন সরকারের এ সময়টায় তা কিছুটা কমেছে, যা সামষ্টিক অর্থনীতির দিক থেকে কিছুটা স্বস্তিদায়ক বলা যায়। কিন্তু মানুষের জীবনযাত্রার মানের যে অবনমন হয়েছে, তা অব্যাহতই থাকবে। কেননা দেশের বাজারগুলোতে এখনো ভোগ্যপণ্যের মূল্যস্তর অনেক ওপরে। তবে মূল্যস্ফীতি কমার যে প্রবণতা শুরু হয়েছে, তা অব্যাহত থাকলে পণ্যের মূল্যস্তর কমবে।
টিসিবির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রতিনিয়ত বাজারে সবজিসহ কিছু কিছু পণ্যের দাম ওঠানামা করলেও আটা, চাল, ডাল, পেঁয়াজ, তেল ও ডিমের মতো ভোগ্যপণ্যের দাম প্রতিযোগিতামূলকভাবে বেড়েছে। এর মধ্যে গত এক বছরে আটার দাম বেড়েছে প্রায় ১৫ শতাংশ, ডিম ১৭ শতাংশ, পেঁয়াজ ৩৩ শতাংশ, তেল ১০ শতাংশ ও ডাল ১৪ থেকে ১৫ শতাংশ।
বাজার ঘুরে দেখা গেছে, সেপ্টেম্বরে প্রতি কেজি খোলা আটা বিক্রি হয়েছে ৫০-৫২ টাকায়, যা এক বছর আগের একই মাসে বিক্রি হয়েছিল ৪৫ টাকায়। আটার মতো ঊর্ধ্বগতিতে ছুটছে চালের দাম। একই মাসে ২৭ শতাংশ বেড়ে প্রতি কেজি মোটা জাতের (স্বর্ণা, চায়না, গুটি) চাল বিক্রি হচ্ছে ৬০-৬২ টাকায়, যা এক বছর আগেও বিক্রি হয়েছিল ৪৭ থেকে ৫০ টাকায়। একইভাবে ১৪-১৫ শতাংশ বেড়ে প্রতি কেজি মসুর ডাল বিক্রি হচ্ছে ১৫০, যা এক বছর আগেও বিক্রি হয়েছিল ১২০ টাকায়।
বাজারে সবচেয়ে অস্থিরতার মধ্যে থাকা পণ্য ডিম। দেশে প্রতিদিন ডিমের চাহিদা চার কোটি, সেখানে দাম নিয়ন্ত্রণের জন্য গত সেপ্টেম্বর মাসে মাত্র আড়াই লাখ ডিম আমদানি করা হয় ভারত থেকে। তবে আকস্মিকভাবে গত কয়েক দিন ডিমের দাম ডজনে কমপক্ষে ২০ টাকা বেড়েছে। কথা রয়েছে আরও ৪৭ লাখ টন ডিম আমদানির, যা দিয়ে এক দিনের চাহিদাও মেটানো সম্ভব নয়।
পেঁয়াজের বাজার গত সরকারের শেষ সময় পর্যন্ত ভারত নির্ভর ছিল। তবে পট পরিবর্তনের পর আমদানির ক্ষেত্রে বহুমুখী বাজার তৈরি হয়েছে। এখন মিসর, থাইল্যান্ড, চীন ও পাকিস্তান থেকে পেঁয়াজ আমদানি হচ্ছে বাংলাদেশে। পরে পেঁয়াজ রপ্তানির শর্ত শিথিল করে ভারত। বর্তমানে চট্টগ্রামের বড় বাজার খাতুনগঞ্জে প্রতি কেজি ভারতীয় নাসিক জাতের পেঁয়াজ ৯৫-৯৭, দক্ষিণ ভারত থেকে আসা পেঁয়াজ ৮৫-৯২, মিয়ানমারের ৭৫-৮০ ও পাকিস্তানি থেকে আসা পেঁয়াজ ৭৮ থেকে ৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তবে এর প্রভাব নেই খুচরা বাজারে। খুচরা বাজারে এখনো এ পণ্যের দাম ১১০ থেকে ১২০ টাকার মধ্যে রয়েছে। অর্থাৎ আমদানি বাজার বাড়লেও খুচরায় দাম কমার খবর নেই। সরকারি তথ্য বলছে, দেশে বছরে এ মসলাজাত পণ্যটির চাহিদা রয়েছে ৪০ লাখ টন। উৎপাদন ভালো হলে তা সর্বোচ্চ ৩৬ লাখ টন পর্যন্ত হয়। বাকিটা আমদানি করতে হয়। যদিও সরকারি তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে সন্দেহ করছে সংশ্লিষ্টরা।
ব্যবসায়ীরা মনে করেন, নিত্যপণ্যের বাজার গুটিকয়েক করপোরেট কোম্পানির হাতে থাকায় ভোগ্যপণ্যের দাম কমছে না। সিটি গ্রুপ, এসিআই, আকিজ, এস আলমের মতো কোম্পানির হাতেই চাল, আটা, তেলের মতো পণ্য আটকে আছে। এ ছাড়া কাজী, প্রোবিটা, প্যারাগন, নরিশ ফার্মস ও আফতাব হ্যাচারির হাতেই আটকে আছে পোলট্রি বাজার। মূলত এসব করপোরেট কোম্পানির সিদ্ধান্তে ভোগ্যপণ্যের বাজার ওঠানামা করে। করোনার পর থেকেই বিশ্ববাজারে তেল, চাল ও আটার দাম কমলেও আমাদের দেশে তেমন একটা কমেনি। তাদের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে যেমন পণ্য বিক্রি করা যায় না।
পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, সরকারি তদারকি সংস্থাগুলো ভালোভাবে মাঠে নেই। সংস্থাগুলো পণ্যবাজার নিয়ন্ত্রণকারী করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে জবাবদিহির আওতায় আনতে ব্যর্থ হয়ে পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীদের ধরতে অভিযান চালাচ্ছে।
কারওয়ান বাজারে চালের পাইকার মুন্সীগঞ্জ রাইস ট্রেডার্সের মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, গত এক বছর বাজারে কয়েক ধাপে চালের দাম বেড়েছে। বিশেষ করে মোটা জাতের (স্বর্ণা, চায়না, গুটি) চালের কেজিতে ১২ টাকা বেড়েছে। চালের বাজার অস্থিতিশীল করার জন্য করপোরেট কোম্পানিগুলো বিশেষভাবে দায়ী। বাজার নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলোকে অভিযুক্ত করে এ ব্যবসায়ী আরও বলেন, যখন চালের বাজার অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে, তখনই ভোক্তা অধিকার আমাদের দোকানগুলোতে অভিযান চালায়। আমি মনে করি আমাদের দোকানে অভিযানের আগে করপোরেট কোম্পানিগুলো মিলে অভিযান করা উচিত।
বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কারণে গেল কয়েক বছর বাজারে ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ছে। তাছাড়া বাজার ব্যবস্থায় কাজ করা রাষ্ট্রায়ত্ত সরকারি সংস্থাগুলোর আন্তরিকতার অভাব থাকায় দেশে প্রতিযোগিতামূলক বাজার ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। তাই দিনে দিনে ভোক্তার পকেট কাটা ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট শক্তিশালী হয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ খাদ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে বেশ পিছিয়ে যাচ্ছে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে খাদ্য আমদানি আগের অর্থবছরের তুলনায় বেড়েছে ৩৬ শতাংশ। এর মধ্যে শুধু গম আমদানিই বেড়েছে ৭১ শতাংশ।
বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি ও বাজার নিয়ন্ত্রণে এখনো সীমাবদ্ধতা রয়েছে উল্লেখ করে অর্থনীতিবিদ ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, মুদ্রানীতি দিয়ে আমাদের দেশের মূল্যস্ফীতির নিয়ন্ত্রণ করার মধ্যে সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তবে আমাদের রাজস্বনীতি, বাজার ব্যবস্থাপনা, সময় অনুযায়ী আমদানি, মজুদ ও সরবরাহ করার পাশাপাশি বাজার ব্যবস্থাপনার অন্যান্য দিকেও নজর দিতে হবে। তাছাড়া বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য ভোক্তা অধিদপ্তর, প্রতিযোগিতা কমিশন ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নজরদারি থাকতে হবে।
সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরা দেখে আসছি দেশে আমদানি থেকে ভোক্তা স্তর ও উৎপাদক থেকে ভোক্তা স্তরের অনেক বড় পার্থক্য রয়েছে। সে ক্ষেত্রে আমরা দেখছি বেশ কয়েকটি পণ্যের ওপর গুটিকয়েক কোম্পানি একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ চালিয়ে যাচ্ছে। সে ক্ষেত্রে আমাদের খেয়াল রাখতে হবে যেন এলসি খোলার ক্ষেত্রে আমদানিকারক কোনো সমস্যায় না পড়েন। এর বাইরেও পণ্য হাতবদলের স্তরগুলো কিছুটা নজরদারি বাড়ানো গেলে বাজার ব্যবস্থাপনায় সুফল আসবে।
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি নাজের হোসাইন বলেন, সরকারের ভোগ্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ করা নিয়ে আমরা কিছুটা সন্দিহান। কারণ হচ্ছে, আগের সরকার বলছিল তারা বিভিন্ন চাঁদা বন্ধের উদ্যোগ নিয়েছে, ব্যাংক ইন্টারেস্ট বাড়িয়েছে ও আমদানিতে শুল্ক ছাড় দিয়েছে। তবে সাধারণ জনগণ এর সুবিধা পাননি। উল্টো ব্যবসায়ীরা পুরো ফায়দা লুটেছে।
১৫ বছরের সুবিধা নেওয়া ব্যবসায়ীরা বর্তমান সরকারের আশপাশেও রয়েছে অভিযোগ করে নাজের হোসাইন আরও বলেন, গত ১৫ বছরের শাসনামলে সরকারের কাছাকাছি থেকে যেসব ব্যবসায়ী সুবিধা নিয়েছে তারা এখন নতুন সরকারের আমলে তাদের পাশে ঘুরঘুর করছে। অর্থাৎ ব্যবসায়ীরা আগে সালমান এফ রহমানকে সামনে রেখে সুবিধা নিয়েছে। এখন নতুন একজনকে ধরেছে। তাছাড়া ভোক্তা অধিদপ্তরের কার্যক্রমও কমেছে। বিষয়গুলো হচ্ছে, আগের মন্ত্রী-এমপিরা যা করতেন, এখনকার সরকারের কাছের লোকদের কথায় সেই একই কাজ হচ্ছে।
বাংলাদেশ সময়: ১২:১২:৫৫ ৯৭ বার পঠিত | বেসামাল পরিস্থিতিভোগ্যপণ্যের বাজার