এম.আমির হোসেন।।ভোলাবাণী।।
“ও বউ ধান ভানেরে ঢেঁকিতে পাড় দিয়া, ঢেঁকি নাচে বউ নাচে হেলিয়া দুলিয়া ও ধান ভানেরে”…। ঢেঁকির কথা বললেই সবার আগে মনে পড়ে যায় পল্লী কবি জসিম উদ্দিনের এই বিখ্যাত ছড়া গানের কথা যা গ্রাম বাংলার মহিলাদের কণ্ঠে প্রায়ই শোনা যেত। যুগেযুগে কবি সাহিত্যিকরা এরকম অসংখ্য গান,কবিতা,ছড়া,প্রবাদ রচনা করেছিলেন ঐতিহাসিক ঢেঁকি কে নিয়ে।আবহমান গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যবাহী ঢেঁকিই ছিলো ভোলা জেলার লালমোহন ( ৮০- দশকের আগে) অঞ্চলের ধান থেকে চাল ও চালের গুঁড়া তৈরির একমাত্র মাধ্যম। এই জনপদের গ্রামাঞ্চলের প্রতিটি বাড়িতে ঢেঁকি ঐতিহ্য বহন করত। ঐতিহাসিক ঢেঁকি লালমোহন থেকে কালের বিবর্তনে আধুনিকতার যান্ত্রিক উৎকর্ষে আজ বিলুপ্তির পথে।অথচ একসময় ঢেঁকি ছাড়া বাড়ী তথা গ্রাম কল্পনা করাই কঠিন ছিল। এখন ঢেঁকির সেই ধুপ-ধাপ শব্দ আর শোনা যায় না। দেখা যায় না গ্রাম্য মহিলাদের ঢেঁকিতে রাত থেকে ভোর পর্যন্ত চাল ভাঙানোর দৃশ্য দিন দিন ঢেঁকির সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে নবান্নের উৎসবও। নতুন প্রজন্মের কাছে এখন ‘ঢেঁকি’ শুধু অতীতের রুপ কথার গল্প। শীত এলেই প্রায় দেখা যেত উৎসবমুখর পরিবেশে ঢেঁকি ছাঁটা চালের গুঁড়া দিয়ে তৈরি হত ফিরনি, পায়েস, ভাপা,পুলি পাটিসাপটা,চিতইসহ নানা ধরনের পিঠা। এ ছাড়াও তৈরি হত বাহারি নকশী পিঠা যেমন - শঙ্খলতা, কাজললতা, চিরল বা চিরনপাতা, হিজলপাতা, সজনেপাতা, উড়িয়াফুল, বেঁট বা ভ্যাট ফুল, পদ্মদীঘি, সাগরদীঘি, সরপুস, চম্পাবরণ, কন্যামুখ, জামাইমুখ, জামাইমুচড়া,ইত্যাদি। বাতাসে ভেসে বেড়াত মন মাতানো পিঠার সুঘ্রাণ।নতুন জামাই ও মেহমান আপ্যায়নে পিঠা ছাড়া যেন অসমাপ্তই থেকে যেত।
বড় মোটা কাঠের গুঁড়ি দিয়ে তৈরি হত ঢেঁকি। যা দৈর্ঘ্যে তিন থেকে চার হাত এবং প্রস্থে আধা হাত থেকে এক হাত। টেঁকি সাধারণত কাঠাল , বাবলা, জাম,কুল ইত্যাদি কাঠ দিয়ে তৈরি হতো। এর অগ্রভাগের মাথার কাছাকাছি শক্ত করে লাগানো থাকে দেড় -দুই ফুট লম্বা শুঁড় বা মনাই। মনাইয়ের মাথায় পরানো হয় লোহার রিং বা লোহার গুলা একে চুরন বলা হয়।চুরন যেখানে আঘাত করে নিচের সেই গর্ত অংশটুকুর নাম গড়। ঢেঁকিতে পাড় দেওয়ার জন্য দুই জন আর আলি দেওয়ার জন্য ১জন লোক লাগে।উভয়ের মধ্যে সঠিক সমন্বয় না থাকলে ঘটত বড় ধরনের দুর্ঘটনা। গরিব অসহায় মহিলাদের উপার্জনের বড় একটি মাধ্যম ছিল এই ঢেঁকি এলাকার বিত্তশালীদের বাড়িতে নতুন ধান উঠলে গরীব অভাবগ্রস্ত মহিলারা ঢেঁকিতে ধান ছেঁটে দিত। এর পারিশ্রমিক দিয়ে অনায়াসে তাদের সংসার চলে যেত।
পুষ্টিবিদরা ঢেঁকিছাটা লাল চালের ভাতে প্রচুর পরিমান ভিটামিন রয়েছে বলে মত দেন।তাই ডাক্তাররা রোগীকে এই চালের ভাত খেতে বলতেন।ঢেঁকি ছাটা চালের পিঠা, ভাত, পোলাও, জাউ আর ফিরনি ছিল অত্যন্ত মজাদার। তাই আসুন আমাদের শৈশবকালের স্মৃতি বিজড়িত গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী ঢেঁকি শিল্পকে সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় হারিয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করি।
বাংলাদেশ সময়: ১০:৫৬:৩৩ ৮২ বার পঠিত |