গল্প।।একুশের প্রভাতফেরি

প্রথম পাতা » সর্বশেষ সংবাদ » গল্প।।একুশের প্রভাতফেরি
বুধবার, ৭ এপ্রিল ২০২১



মো. মোস্তাফিজুর রহমান

আবির ও তনয় দাদুর সাথে প্রভাতফেরিতে যাবে। কারণ, কাল একুশে ফেব্রুয়ারি “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস”। একুশের প্রথম প্রহরে শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা নিবেদন করবে । তাই আগের দিন থেকেই তাদের প্রস্তুতি চলছে, মা’কে বলে রেখেছে জামা গুছিয়ে রাখতে।

তাদের মাঝে যেন ঈদ আনন্দ, কখন প্রভাত হবে, দাদু তাদের শহীদ মিনারে নিয়ে যাবে।
ভোর না হতেই তারা প্রস্তুত, দাদু এসে দরজায় কড়া নাড়লো, আবির ও তনয় বলে উঠলো দাদু এসেছে মনে হয়। দরজা খোলে দেখলো সত্যিই তাদের দাদু ফুল হাতে দরজায় দাঁড়িয়ে —-!

একুশের প্রভাতফেরি

দাদু, আবির ও তনয়ের জামাতে দু’টি কালো ব্যাজ পরিয়ে দিলো। তারা কৌতূহলী মনে প্রশ্ন করলো দাদু কালো ব্যাজ কেন পরতে হবে?
দাদু বলল, আজকের এই দিনটির পেছনে একটি গল্প আছে ভাই, তাহলে গল্পটি শোনাও দাদু, না; আগে চলো ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা নিবেদন করে আসি। এসে তোমাদের গল্পটি শোনাবো। না, দাদু! আগে গল্প শোনবো। গল্প না শোনে শহীদ বেদিতে যাবো না।
আচ্ছা, ঠি-ই-ক আছে, যেতে যেতে গল্প শোন তাহলে। ওকে দাদু, চলো—আমরা যে ভাষায় আজ কথা বলি, তার নাম জানো কী তোমরা? হ্যাঁ জানি, দাদু; বাংলা ভাষা। এটা আমাদের মাতৃভাষা, মায়ের মুখে শেখা ভাষা।
তোমরা সত্যিই বলছো, তবে এ ভাষা কিন্তু বিনা রক্তে অর্জিত হয় নি? ভাষা অর্জনে রক্ত কেন, দাদু?

দেশ স্বাধীন হওয়ার আগের কথা, আমরা পাকিস্তানের অংশ ছিলাম। পাকিস্তান রাষ্ট্রের দু’টি অংশ ছিল, একটি পূর্ব পাকিস্তান অন্যটি পশ্চিম পাকিস্তান। আমরা পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসী ছিলাম। দুই অংশের মধ্যে ব্যবধান ছিলো বিস্তর, ভৌগোলিক ভাবে দূরত্ব প্রায় ১২০০ কিলোমিটার, ভাষা ও সংস্কৃতিতে ব্যবধান ছিলো আরও বেশি।

আমরা বাঙালি, বাঙলা ভাষায় কথা বলতাম। আর তারা উর্দুতে কথা বলতো, তবে ধর্মে সদৃশতা ছিল। ধর্মের সদৃশতা দেখিয়েই অবশ্য দু’টো রাষ্ট্র কে এক করে ছিল তারা।

তারপর, তারা শুরু করে নানান নিপীড়ন, প্রথমেই আঘাত হানে বাংলার ভাষা ও সংস্কৃতিতে।
১৯৪৮ সালে পাকিস্তান অধিরাজ্য সরকার ঘোষণা করে উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা, এতে পূর্ব পাকিস্তানের বাংলা ভাষা-ভাষী সর্বসাধারণ ক্ষোভে ফেটে পড়ে, শুরু হয় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জোরালো প্রস্তুতি।

এরই মধ্যে ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা করেন, “উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা “। তার এ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে ছাত্র-জনতা প্রতিবাদ মিছিল করে।
এরপর পরিস্থিতি কিছুটা টালমাটাল থাকা কালেই তিনি আবারও ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সভায় একই ঘোষণা করেন; এতে ছাত্ররা সাথে সাথে তীব্র প্রতিবাদ জানায়।

এরপর চলতে থাকে মৃদুমন্দ নিরবতা, এবার ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি খাজা নাজিমুদ্দিন করাচি থেকে ঢাকায় আসেন, এবং পল্টন ময়দানে এক জনসভায় বলেন, প্রদেশের সরকারি কাজকর্মে কোন ভাষা ব্যবহৃত হবে তা প্রদেশের জনগণই ঠিক করবে। কিন্তু পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে কেবল উর্দু। সঙ্গে সঙ্গে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয় এবং ‘রাষ্টভাষা বাংলা চাই’ শ্লোগানে ছাত্ররা বিক্ষোভ শুরু করেন।

৩০ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মঘট পালিত হয়। ৩১ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের সভাপতি মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দলের প্রতিনিধিদের এক সভায় ‘সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়, আহবায়ক হন কাজী গোলাম মাহবুব।

এ সময় পশ্চিম পাকিস্তান সরকার আরবি হরফে বাংলা লেখার প্রস্তাব দেয়। এর বিরুদ্ধেও তীব্র প্রতিবাদ উঠে। এবং, রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ ( ০৮ ফাল্গুন ১৩৫৮) সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল, জনসভা ও বিক্ষোভ মিছিলের সিদ্ধান্ত নেয়।

এতে আঁচ পেয়ে সরকার ঢাকা শহরে ১৪৪ ধারা জারি করে সভা-সমাবেশ-শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ২০ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় আবুল হাশিমের সভাপতিত্বে কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে ১৪৪ ধারা অমান্য করা হবে কি’না মতবিরোধ দেখা দেয়; তবে ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সঙ্কল্পে অটুট থাকে।

পরদিন সকাল ১১টায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ সংলগ্ন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় ছাত্রদের সভা হয়। সভা শুরু হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষকসহ উপাচার্য ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার জন্য ছাত্রদের অনুরোধ করেন। তবে ছাত্র নেতৃবৃন্দ, বিশেষ করে আবদুল মতিন এবং গাজীউল হক নিজেদের অবস্থানে অনড় থাকে। ঢাকা শহরের স্কুল-কলেজের হাজার হাজার ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে সমবেত হতে থাকে।

এর’ই মধ্যে, এক ফাঁকে ছাত্ররা পাঁচ-সাত জন করে ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়, এবং ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ শ্লোগান দিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে আসে। এসময় পুলিশ তাঁদের উপর লাঠিচার্জ করে, ছাত্রীরাও এ আক্রমন থেকে রেহাই পায়নি। ছাত্রছাত্রীরা পুলিশের দিকে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ শুরু করলে পুলিশ কাঁদুনে গ্যাস ছাড়ে। পরিস্থিতি তীব্রতর হলে গণপরিষদ ভবনের দিকে অগ্রসরমান মিছিলে পুলিশ গুলিবর্ষণ করে।

এতে রফিক, সালাম , জব্বার, বরকত ও শফিউর নিহত হয়। এমনকি অহিউল্লাহ্ নামে আট/নয় বছরের এক কিশোরও নিহত,হয়েছিল সেদিন।

পরের দিন ২২ ফেব্রুয়ারি ছিল গণবিক্ষোভ, নিহতদের গায়েবানা জানাজা নামায ও শোকমিছিল । শোকমিছিলেও পুলিশ ও মিলিটারি পুনরায় লাঠিচার্জ, গুলিবর্ষণ ও বেয়োনেটের খোঁচা দেয়।

২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ ভাষা শহীদদের স্মৃতিতে, নিহতের স্থানে নির্মাণ করা হয়, প্রথম স্মৃতিস্তম্ভ, যা শহীদ মিনার নামে পরিচিত ।

এর থেকেই বাংলার মানুষ, প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারি প্রভাতফেরিতে গিয়ে শহীদ বেদিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায়, আর ভাষা শহীদদের স্মরণ করে। তাদের রক্তের ঋণ কোন দিন শোধ হবে না।

দাদু, কী ভয়ানক অবস্থা ছিল তখন, আমাদের ভাষা তারা কেঁড়ে নিতে চেয়েছিল, আর ভাষা শহীদরা তা রুখে দিলো।
সালাম জানাই এমন বীর শহীদদের, চলো এবার শহীদ মিনারে ফুলেল শ্রদ্ধা জানাবো আর তাঁদের জন্য প্রাণ ভরে দোয়া করবো। ভালো থেকো হে বীর শহীদরা।

তবে, হ্যাঁ ভাষা শহীদ ভাইয়েরা। তোমরা জেনে খুশি হবে যে, তোমাদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি, ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছে। বাংলা আজ বিশ্বজনীন! বাংলা ভাষার পতাকা তোমরাই উড়িয়ে গেলে বিশ্বময়। তোমরাই জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান! বাংলার বাতিঘর।

লেখক….
মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান
উপজেলা আনসার ও ভিডিপি কর্মকর্তা
নেত্রকোণা সদর, নেত্রকোণা।
০১৭৫৩২৫৬৭৪৮

বাংলাদেশ সময়: ১৮:১১:২৭   ৮৮ বার পঠিত  |




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

সর্বশেষ সংবাদ’র আরও খবর


ভোলা সদর উপজেলা নির্বাচন ২০২৪আপনাদের পবিত্র ভোট ৫ বছরের জন্য ভাল পাত্রে জমা রাখবেন-মোহাম্মদ ইউনুছ
দেশ ভাঙার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত কংগ্রেস: নরেন্দ্র মোদি
ঝুঁকি নিয়ে সাঁকো পারাপার খালের উপর ব্রিজ নির্মানের দাবী মনপুরাবাসীর ॥
লালমোহনে সাংবাদিকদের সাথে উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীর মতবিনিময়
লালমোহনে আবাসনের ঘর জবরদখলের অভিযোগ
উপজেলা পরিষদ নির্বাচন ২৪ভোলার ৩ উপজেলায় ৩৮ প্রার্থীর মনোনয়ন পত্র দাখিল
কাউকে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ন করতে দেব না : প্রধানমন্ত্রী
প্রচণ্ড গরমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটি ঘোষণা
শশীভূষণে পানিতে ডুবে দুই সহোদরের মৃত্যু
বিদ্যুতের ভেলকিবাজিতে অতিষ্ট ব্যবসায়ীসহ গ্রাহকবিদ্যুত বিহীন মনপুরা ॥ তীব্রতাপদাহে ভোগান্তিতে সাধারন মানুষ

আর্কাইভ