আজ ভয়াল ১২ ই নভেম্বর দক্ষিনাঞ্চলবাসীর জন্য শোকের দিন

প্রথম পাতা » প্রধান সংবাদ » আজ ভয়াল ১২ ই নভেম্বর দক্ষিনাঞ্চলবাসীর জন্য শোকের দিন
বৃহস্পতিবার, ১২ নভেম্বর ২০২০



মোঃ ছালাহউদ্দিন।।ভোলা বাণী।।মনপুরা প্রতিনিধি ॥
আজ ভয়াল ১২ই নভেম্বর। ৫০ বছর আগের সেই দিনের বেদনা বিধুর ইতিহাস বাঙালী জাতি আজও ভুলতে পারেনি। ১৯৭০ সালের এই দিনে সমগ্র উপকূল জুড়ে বয়ে যায় মহা প্রলয়ংকরী ঘূর্নীঝড় ও জলোচ্ছাস গোর্কি। ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত বুঝতে না পারার খেসারত দিতে হয়েছে উপকুলের ১০ লক্ষাধিক নিরক্ষর মানুষের প্রাণ বিসর্জনের মধ্য দিয়ে। ভেসে যায় গবাদি পশু, হাঁস-মুরগী আর ক্ষতিগ্রস্ত হয় মাঠ ফসল এবং অসংখ্য গাছপালা। পুরো উপকূল মুহুর্তেই ধ্বংসজজ্ঞে পরিণত হয়। চারদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে লাশ আর লাশ। বাতাসে লাশের গন্ধ আর স্বজনদের আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে এলাকার আকাশ বাতাস। ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা, নোয়াখালী ও চট্রগ্রামের উপর দিয়ে বয়ে যায় এই ঘূর্নীঝড় ও জলোচ্ছাস।

আজ ভয়াল ১২ ই নভেম্বর দক্ষিনাঞ্চলবাসীর জন্য শোকের দিন

ইতিহাস পর্যালোচনা করে এবং প্রত্যক্ষদর্শী ভূক্তভোগীদের সাথে আলাপ করে জানা যায়, ১৯৭০ সালের ১২ই নভেম্বর সকাল থেকেই গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হ”িছল। বিকেলের দিকে বাতাস বাড়তে থাকে। রাতের দিকে আবহাওয়া অধিদপ্তর প্রচার করতে থাকে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত। বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্মচাপটি হারিকেনের রুপ ধারন করেছে এবং যার প্রভাবে উপকূলীয় এলাকায় ২০ Ñ ২৫ ফুট উচ্চতায় জলোচ্ছাসের সম্ভাবনা রয়েছে।কিš‘ দুর্ভাগ্য হলেও সত্যি যে, উপকূলের বঞ্চিত মানুষের কানে এ সতর্কবানী পৌছেনি। তখন ছিল পবিত্র রমজান মাস। সবাই রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। গভীর রাতে হঠাৎ মানুষের আত্মচিৎকারে সবাই জেগে ওঠে। বাইরে প্রচন্ড বেগে বাতাস বইছে। চোখের পলক ফেলতে না ফেলতেই তীব্র গতিতে জোয়ারের তোড়ে প্রথমে উঠোন, সাথে সাথে ঘর ডুবে আসবাবপত্র ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। মানুষ কি করবে ভেবে পাচ্ছেনা। সবাই দ্বিগি¦দিক ছোটাছোটি করে বেঁচে থাকার লড়াইয়ে লিপ্ত হয়।

ঘর-বাড়ি, গাছ-পালা ভাঙ্গার বিকট শব্দের সাথে যুদ্ধংদেহী প্রকৃতির ভয়ংকর গর্জনে মনে হয়েছে যেন কেয়ামত বুঝি শুরু হয়ে গেল। মানুষের বেঁেচ থাকার করুন আকূতি। কেউ টিনের চালায়, কেউ গাছের মগডালে, কেউ হাতের কাছে যা পেয়েছে তাই ধরে বেঁচে থাকার শেষ চেষ্টা করেছে। এতেও শেষ রক্ষা হয়নি অনেকের। জলো”ছ¡াসের তোড়ে ভেসে গিয়ে মুহুর্তের মধ্যে প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছে লক্ষ লক্ষ নিরীহ মানুষকে।

শেষ রাতের দিকে মুহুর্তেই প্রকৃতি শান্ত হয়ে যায়। আস্তে আস্তে পানি নেমে যায়। চতুর্দিকে ভেসে আসে মানুষের আর্তনাদ। সন্তান হারা মায়ের কান্না, মা হারা সন্তানের চিৎকার, ভাই হারা বোনের বুকফাটা ধ্বনিতে আকাশ বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। সর্বহারা মানুষগুলো একে অপরের মুখের দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে লজ্জ্বা ঢাকার জন্য এক টুকরো ছেঁড়া কাপড় খুজতে থাকে।

১২ই নভেম্বরের মহাপ্রলয়ংকরী ঘূর্নীঝড় ও জলোচ্ছস সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত করেছে ভোলা জেলার বিচ্ছিন্ন দ্বীপ উপজেলা মনপুরাকে। মনপুরার কোথাও বেড়ী বাঁধ কিংবা সাইক্লোন শেল্টার তখনও গড়ে ওঠেনি। ২৫-৩০ ফুট উচু ঢেউ ও জলোচ্ছাসে মনপুরার ৩০ সহস্রাধিক মানুষ ও গবাধি পশু সমুলে নিমিষেই স্রোতের টানে ভেসে গেছে উত্তাল সাগরে।

প্রকৃতি শান্ত হলে দেখা যায়, গাছে গাছে ঝুলে আছে লাশ। যেখানে সেখানে লাশ আর লাশ। সাপ আর মানুষের একসাথে জীবন বাঁচানোর শেষ চেষ্টার নিদর্শন দেখে মানুষ যেমন হয়েছে আতংকিত তেমনি হয়েছে অভিভুত। মনপুরায় বেঁচে ছিল মাত্র ৮ হাজার স্বজন হারানো ব্যাথাতুর মানুষ।

ভোলা জেলার লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যূর খবর আর ঘূর্নিঝড়ের তান্ডবে লন্ডভন্ড উপকূলীয় জনপদের বেদনার্ত কাহিনী ৫ দিন পর রাজধানী জানতে পারে তৎকালীন দৈনিক পুর্বদেশ পত্রিকার মাধ্যমে। বর্তমানে ভোলা থেকে প্রকাশিত দৈনিক বাংলার কন্ঠের সম্পাদক ও ভোলা প্রেস ক্লাবের সভাপতি মোঃ হাবিবুর রহমান ছিলেন সেই সময়ের পূর্বদেশ পত্রিকার ভোলা জেলা প্রতিনিধি। পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশের পর সরকারের নজরে আসলে মাথা ঘুরে যাওয়ার অবস্থা।

মুহুর্তের মধ্যে প্রশাসনের পাশাপাশি বিভিন্ন সংস্থা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। পর্যায়ক্রমে আসতে থাকে ম্যাচ, মোমবাতি, চিড়া, মুড়ি, শাড়ি, লুঙ্গি, গেঞ্জি, পাঞ্জাবি, তেল, লবন, খাবার পানি, পানি বিশুদ্ধকরন ট্যাবলেট, সাবান, প্যান্ট-শার্টসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সকল দ্রব্যসামগ্রী। কিছুক্ষন পরপর হেলিকপ্টারের হু হু শব্দ আর হেলিকপ্টার থেকে বিভিন্ন দ্রব্যসামগ্রী ফেলে যাওয়া আজও দক্ষিনাঞ্চলবাসীর মনকে নাড়া দেয়। সেই দিনের আলোচনা উঠলে এখনো অনেকেই নীরবে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন।

মনপুরার বিশিষ্ট পান ব্যাবসায়ী ইয়াছিন বেপারী দিনটির স্মিৃতি চারন করতে গিয়ে বাকরুদ্ধ কন্ঠে বলেন, সেইদিন ছিল বৃহস্পতিবার। আমি প্রতিদিনের ন্যায় নাইবের হাট বাজারে পান বিক্রি করতে যাই। সারাদিন গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হয়। বিকাল বেলা আকাশ মেঘে ঢেকে ফেলে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে আকাশের অবস্থা খারাপ দেখে পান বিক্রি বন্ধ করে বাড়ী চলে আসি। তখন রাত আনুমানিক ৯ টা হবে। খাবার খেয়ে ২ ছেলে ১ মেয়ে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। গভীর রাত হঠাৎ দেখি ঘরের ভিতর পানি। জোয়ারের প্রচন্ড গতি ও বাতাসের তীব্রতায় মুহুর্তের মধ্যে এক বুক পানি হয়ে গেছে।তাড়াতাড়ি করে স্ত্রী, ২ছেলে ও ১মেয়েকে নিয়ে ঘর থেকে বাহির হয়ে একটি গাছে উঠি। আমি আমার ছেলে হেলাল, বেলালকে ধরি এবং মেয়ে মহিমাকে তার মা নুরভানু ধরে। কিš‘ একদিকে বাতাস অন্যদিকে জোয়ারের তোড়ে শিশু সন্তানদেরকে ধরে রাখতে পারিনি। সেদিনের দঃসহ স্মৃতির কথা মনে পড়লে আজও কান্না ধরে রাখতে পারিনা বলে চোখের এক কোনা থেকে অশ্রু ঝরতে থাকে তার।

দিনটির স্মৃতিচারন করতে গিয়ে মনপুরা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার আঃ লতিফ ভূইয়া বাকরুদ্ধ ও আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন। তিনি বলেন, ঐসময় আমাদের বাড়িতে ২টি দুইতলা টিনের ঘরসহ মোট ৫টি বসতঘরে প্রায় ৪০/৪৫ জন মানুষ ছিল। রাতে যখন প্রবল বেগে জোয়ার আসতে শুরু করল, তখন আমরা হতবাক হয়ে পড়ি। সবাই যার যার মত করে বিভিন্ন গাছ ধরে বাঁচার শেষ চেষ্টা করে। আমি প্রথমে একটি আম গাছে আশ্রয় নিই। প্রচন্ড ঝড় ও ঢেউয়ের আঘাতে আম গাছটি ভেঙে গেলে পরে একটি খেজুর গাছের মাথায় উঠি। সকাল বেলা যখন জোয়ার নেমে যায় তখন সব আত্মীয় স্বজনকে খুজতে থাকি। মা-বাবা, অবিবাহিত বোন, ভাই, ভাইয়ের বৌ, ভাতিজাসহ প্রায় ২৫/২৬ জন লোক মারা গেছে শুধু আমাদের বাড়িতেই। সেদিনের কথা মনে পড়লে আজও গা শিউরে উঠে।

হাজীর হাট ইউনিয়নের সংরক্ষিত ইউ.পি সদস্যা মফিজা খাতুন বলেন, প্রচন্ড ঝড়বৃষ্টি ও ঢেউয়ের মাঝে আমার কোল থেকে ৫ মাসের কন্যা সন্তানটি পড়ে গেলে তাকে ধরার ব্যর্থ চেষ্টা করি। আমাকে প্রচন্ড স্রোতে বাড়ি থেকে ভাসিয়ে নিয়ে গেলে বেঁচে থাকার জন্য মরা গরুর লেজ ধরি। এই লেজ ধরা অব¯’ায় বঙ্গোপসাগরে ৭ দিন ভাসতে থাকি। এরপর কক্সবাজার থেকে ৩ শত মাইল দক্ষিনে বঙ্গোপসাগর থেকে বহিরাগত একটি জাহাজ আমাকে তুলে চট্রগ্রামের একটি হাসপাতালে ভর্তি করে। ১ মাস পর মনপুরায় ফিরে আসি।

সাকুচিয়া ইউ.পি’র সাবেক চেয়ারম্যান ডা.কামালউদ্দিন বলেন, ভাগ্য ভাল মায়ের লাশটি পরদিনই পেয়েছি। সবাই তখন স্বজন হারা। মৃতের সংখ্যা এতই বেশি ছিল যে ১০/১২ জনকে একসাথে মাটি দিতে হয়েছে। ক্ষুধার জ্বালা নিবারনের জন্য জীবিতরা আশেপাশে পড়ে থাকা চাল কুড়িয়ে নারিকেল উঠিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতে হয়েছে হেলিকপ্টার দিয়ে ফেলানো চিড়াগুড়ের সাথে ম্যাচ ও লবন পেয়েছি ৩ দিন পর।

১২ ই নভেম্বরে স্বজনদের মৃত্যূকে স্মরন করে ভোলায় বিভিন্ন সংগঠন মসজিদ ও মন্দিরে দোয়া, মিলাদ ও বিশেষ প্রার্থনা করে। মনপুরা সমাজ উন্নয়ন সংস্থা শোকাবহ দিনটি পালনে প্রথম উদ্যোগ গ্রহণ করে।

বাংলাদেশ সময়: ০:১২:২৭   ২০৪ বার পঠিত  |




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

প্রধান সংবাদ’র আরও খবর


ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাল ইসরায়েল
৩ মাস ধরে বন্ধ বিদ্যুৎ প্লান্টতীব্র গরম আর বিদ্যুতের ভয়াবহ লোডশেডিংয়ে অতিষ্ঠ ভোলাবাসী
মনপুরায় প্রাণিসম্পদ প্রদর্শনী মেলার উদ্ভোধন ॥
চরফ্যাশনে স্বামীর প্রহার থেকে স্ত্রীকে রক্ষা করতে গিয়ে আহত-৩
চরফ্যাশনে সাংবাদিক পরিচয়ে চাঁদাবাজীতে অতিষ্ঠ মানুষ
চরফ্যাসনে তুচ্ছ ঘটনায় প্রতিপক্ষের হামলায় আহত ৯
ইসরায়েলকে ‘সহায়তা করা’ নিয়ে মুখ খুলল সৌদি
প্রিয়জনদের সঙ্গে ঈদ উদযাপন শেষেকর্মস্থলে ফিরছে মানুষ, ইলিশা ঘাটে যাত্রীদের চাপ
আইপিএলে চতুর্থ দ্রুততম সেঞ্চুরিয়ান ট্রাভিস হেড
উত্তর দিঘলদী ইউনিয়নে জনসভা ও পথসভা করেছেন চেয়ারম্যান প্রার্থী মোহাম্মদ ইউনুছ

আর্কাইভ